পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৮৯

এছাড়া নভেম্বরের দিকে ঢাকা শহরে আমরা আরো কয়েকটি অপারেশন করি। সেগুলি ছিল রেডিও বাংলাদেশ (শাহবাগ), মালিবাগ রেলক্রসিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি এলাকায় অপারেশন। মালিবাগ রেলক্রসিং-এর কাছে রেললাইন উড়িয়ে দিতে গিয়ে ভোর চারটা থেকে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এতে তাদের একটি সেকশন পুরোপুরিভাবে বিনষ্ট হয়। একই মাসে আমরা বাংলাদেশ রেডিও (শাহবাগ) আক্রমণ করি এবং পাহারারত বহু পাকসেনাকে আঘাত হানি। এই অপারেশনে আমরা কিছু পাকসৈন্যকে খতম করে অন্যত্র সরে যাই।

 আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের পরিকল্পনা করি অক্টোবরের দিকে। তখন দখলদার পাক সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ চালু করার চেষ্টা করছিল। আমরা এই সংবাদ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু এক্সপ্লোসিভ বসাই। প্রথমে সাইকোলজি বিভাগে একটি এবং তিনতলা, চারতলাতেও কিছু এক্সপ্লোসিভ বসাই। এই অপারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ চলা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আমাকে খোজাখুঁজি শুরু হয় এবং আমার বাড়ি তল্লাশী করে আমার পাঁচ ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

 আমরা আরো একটি অপারেশন করি অক্টোবরের প্রথম দিকে, সাভারের রেডিও স্টেশনের সামনে। এই পথে আমরা তিনটি পাকিস্তানী লরী আক্রমণ করি এবং প্রায় ৩৭ জন পাকসৈন্য হত্যা করি। এরও আগে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে শেষের দিকে সাভারে আমরা একটি অপারেশন করেছিলাম। এটি হয়েছিল সাভার রেডিও স্টেশন থেকে মানিকগঞ্জের বড়াল ব্রীজ পর্যন্ত প্রায় ৩০ মাইল এলাকা জুড়ে। এই হাইওয়ে অপারেশনে আমরা একদিনে প্রায় চারশ ছেলেকে কাজে লাগাই এবং ৩০ মাইলের মধ্যে আমরা ৩১৯ জন রাজাকারকে আত্মসমপর্ণে বাধ্য করি এবং তাদের কাছ থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিই।

 ১৪ নভেম্বরের ভায়াডুবি ব্রীজ অপারেশন ছিল আমাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গেরিলা অভিযান। এখানে আমরা প্রচণ্ডে সংঘর্ষে লিপ্ত হই। শত্রুসেনারা সংখ্যায় ছিল ২০ জন। আমাদের আক্রমণ ভাগে ছিল ৪৪ জন। পাঁচ জনের ওপর দায়িত্ব ছিল ব্রীজ দখলের। সে ৫ জন ছিল মেজবাহউদ্দিন সাবু, সুবেদার আশরাফ, সুবেদার ওয়াজেদ হাকিম এবং আমি। আমরা সব শত্রুসেনাকে খতম করে অবশেষে ব্রীজটা দখল করতে সমর্থ হই। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি এলএমজি, একটি ২" মর্টার এবং একটি স্টেনগান। এ দিয়ে আমরা ব্রীজটা দখল করি। তবে আমরা বেশী সময় ব্রীজটা দখলে রাখতে পারিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা পুনরায় শত্রুর দখলে চলে যায়। তারা মানিকগঞ্জ থেকে তিন গাড়ি সৈন্যসহ (প্রায় ৭০০ জন) ব্রীজ অভিমুখে রওয়ানা হয়। রাত্রি তখন গভীর। তারা মানিকগঞ্জের দিক থেকে আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমরা এক ভীষণ সংঘর্ষে লিপ্ত হই। এই যুদ্ধে আমাদের প্লাটুনের অধিনায়ক মানিক শহীদ হয় এবং বেশ কয়েকজন যোদ্ধা আহত হয়। আমরা সেখান থেকে পিছু হটে যাই। এর চারদিন পর ১৮ নভেম্বর পুনরায় ব্রীজটা আমরা দখল করি এবং পরবর্তীতে উড়িয়ে দেই। এরই মধ্যে ধামরাই এলাকাও আমরা পুরোপুরি মুক্ত করে ফেলি। ধামরাইতে ১৫০ জনের একটি কোম্পানী মোতায়েন রেলে মূল ক্যাম্প সাভারের জিরাবতে স্থানান্তরিত করি। এখান থেকেই আমার সাভারের মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিই এবং উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাকে বিছিন্ন করে ফেলি। সাভারে তখন পাকিস্তানীদের বড় ধরনের ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পটি আমরা ঝটিকা আক্রমণের মাধ্যমে দখল করে ফেলি। আক্রমণটি চালানো হয় নভেম্বরের শেষ দিকে। এর পরপরই আমরা সাভার থানা দখল করি, ফলে পুরো সাভার এলাকাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

 ১৩ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল থেকে ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট মিত্র বাহিনীর চাপে পিছু হটে ঢাকার দিতে আসছিল। আমরা এই রেজিমেণ্টকে সাভারের কাছে বাধা দিই এবং ফলে সেখানে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে আমরা পুরো শক্তি কাজে লাগাই এবং ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টকে আত্মসমর্পণ করাই। এখানে শত্রুপক্ষের প্রায় শতাধিক সৈন্য নিহত হয় এবং একজন পাকিস্তানী সুবেদার মেজর আত্মসমর্পণ না করে আত্মহত্যা করে। আমাদের মুক্তির পূর্ব মুহূর্তের এ যুদ্ধই ছিল এ এলাকার সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমরা টিটোকে