পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪০

 আমরা বাংলাদেশ থেকে ভারত সীমান্ত রসদপত্র রাখার ব্যবস্থা করাই। সেদিন সব ব্যবস্থা করা হয়। তার সাথে সাথে বার্টার সিস্টেমে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস তারা দেবেন বলেও স্বীকার করেন।

 আমরা আমাদের এলাকাটাকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত রাখার জন্য চতুর্দিকে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি তৈরী করি। যে সব রাস্তা দিয়ে হানাদার বাহিনীর চলাচল করার সম্ভাবনা ছিল সেসব রাস্তার গুরত্বপূর্ণ সেতুগুলো ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। যেমন, চৌদ্দগ্রাম-লাকসাম রাস্তার ডাকাতিয়া নদীর উপর বড় সেতু হরিকোট পুল, ফেনী-লাকসাম রেলওয়ে রাস্তার বড় সেতু পরিকোট ব্রীজ। নোয়াখালীরও অনেক গুরুত্বপূর্ন ব্রীজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পরিকোট ব্রীজের সত্বর মেরামতের কাজ দেখার জন্য কুখ্যাত টিক্কা খান পরিদর্শনে এসেছিল।

 লাকসামে আমাদের অবরোধ প্রতিহত করতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা মারমুখি হয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় চারদিন অনবরত যুদ্ধের পর আমাদেরকে লাকসাম ছাড়তে হয়।

 লাকসাম-নোয়াখালীর প্রবেশপথে খণ্ড খণ্ড বহু যুদ্ধ হয়। যার নেতৃত্ব করার জন্য সুবেদার লুৎফরকে ভার দেয়া হয়েছিল। বহুদিন খণ্ডযুদ্ধ চলার পর ভারী আধুনিক অস্ত্রের অভাবে পিছু হটতে বাধ্য হই।

 সামান্য কিছু অস্ত্র নিয়ে ভারত থেকে মাঝে মাঝে এম সি এ নুরুল হক যুদ্ধক্ষেত্রে আসতেন। তাকে দেখে আমাদের লোকজন দ্বিগুণ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে যুদ্ধ করার মনোবল পেতে।

 সমুদ্রপথে পশ্চিম পাকিস্তানীদের আক্রমন প্রতিহত করতে চারদিক দিয়ে বহু বাঙ্কার তৈরী করা হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের শক্তিশালী অবরোধ দেখে নোয়াখালী থেকে ফেনী না এসে লাকসাম থেকে ফেনীর পথে রেল পথে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অগ্রসর হয়। পরিকোট পুলের নিকটে প্রায় একদিন যুদ্ধ চলে। তাদের ত্রিমুখি আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের লোকজন পিছু হটতে আসে। আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঐ দিনই পাকিস্তানী সেনাদেরকে তিন দিকে আটক করে রাখে- নোয়াখালীর পশ্চিম দিকে, ফেনীর উত্তর দিকে ও বুরবুরিয়া ঘাট এলাকায়।

 পশ্চিম পাকিস্তানীরা একদিন গুণবর্তীতে অপেক্ষা করার পর অতর্কিতে ফেনীর তিন দিক ঘিরে ফেলে। আমাদের লোক মারমুখি হয়ে বার ঘণ্টার মত তাদেরকে বহু কষ্টে ঠেকিয়ে রাখে। কিন্তু তাদের ভারি আধুনিক অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে ফেনী ছাড়তে বাধ্য হয় এবং ভারতের সীমান্তে গিয়ে একত্রিত হয়। তখন ছিল মে মাস।

 একিনপুরে আমরা সবাই একত্রিত হই। একিনপুর থেকে ৪ কোম্পানী সৈন্য নিয়ে শুভপুর বুরবুরিয়া ঘাট মুহুরী নদী ও ছাগলনাইয়া ফ্রণ্টে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাই। পাক সেনাবহিনী একদিন অতর্কিতে ছাগলনাইয়ার বাঙ্কার তৈরী করে অপেক্ষা করছিলাম। তাদের কিছুসংখ্যককে মুহরী নদী পার হতে দেই এবং অতর্কিতে তাদের উপর হামলা চালানো হয়। অনেক পাকসৈন্য নিহত হয়। এমনকি তাদের লাশ নেবার জন্য কোন লোক দেড় দিন পর্যন্ত আসে নাই। বাধ্য হয়ে সকল সৈন্যসামন্ত নিয়ে ভারতে আসতে হয়। আমরা ১নং সেক্টরে প্রথম পর্যায়ে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত হই। আমার কিছুসংখ্যক লোক খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২নং সেক্টরে যুদ্ধ করে।

স্বাক্ষরঃ এনামুল হক চৌধুরী
৭-১১-৭৩