পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম খণ্ড
৬৭

 আমি বললাম, “না, এখন নয়। এটা বোধ হয় পর্যবেক্ষণ গাড়ী। রাস্তা পরিস্কার আছে কিনা দেখার জন্য এসেছে। মনে হয় সৈন্যদের আরো বড় দল এই রাস্তায় আসবে। সেই লক্ষ্যবস্তই হবে আমাদের জন্য উত্তম। একসংগে অনেক লোককে পেয়ে যাবো।” একটু পরেই আরেকটি গাড়ি একই পথে চলে গেলো। কিন্তু সৈন্যদের বড় দলটি আর এলো না। মিনিট দশেক পর দুটি গাড়ীই ফিরে এলো এবং ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে চলে গেলো।

 পরবর্তীকালে জানতে পেরেছিলাম, প্রথম গাড়িতে করে মেজর জিয়া পোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন। তার কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে এম, ভি, সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টে আনার জন্য তিনি রওনা হয়েছিলেন। ষ্ট্যাণ্ডার্ড ব্যাংকের চট্টগ্রামস্থ নিউ মার্কেট শাখার ম্যানেজার জনাব কাদের যখন আমার বার্তা নিয়ে ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দফতরে যান তার আগেই মেজর জিয়া বার্তাটি পান। খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে থামানোর জন্য পোর্টের দিকে রওনা হয়ে যান। ২৫শে মার্চ রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের সৈন্যরা এই মধ্যে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের ওপর হামলা চালায়। ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈন্য ও অফিসারবৃন্দ তখনো এ খবর জানতে পারেননি। পুর্বে উল্লেখিত দ্বিতীয় গাড়িতে ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। আগ্রাবাদ পর্যন্ত গিয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা জানালে মেজর জিয়া ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট লাইনে ফিরে আসার এবং তার অফিসারদের সঙ্গে পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন। মেজর জিয়াকে বহনকারী প্রথম গাড়িটি দেখেই নায়েব সুবেদার আইজুদ্দিন উত্তেজিত হয়ে আক্রমন করতে চেয়েছিলো। রেলওয়ে হিলের পাশের এই সড়কের অনেকখানি আমাদের এল-এম-জি এবং রকেট লাঞ্চারের সুনির্দিষ্ট আওতার মধ্যে ছিল। আমরা ধৈর্য্য না ধরলে মেজর জিয়া এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে বহনকারী গাড়ি দুটি রকেট লাঞ্চারের গোলায় উড়ে যেতো। আরো বড় শিকারের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম বলেই অলৌকিকভাবে সেদিন তারা দুজন বেঁচে গিয়েছিলেন।

 ইউনিট লাইনে ফিরে মেজর জিয়া এবং তার অফিসাররা কমাণ্ডিং অফিসারসহ অবাঙ্গালী অফিসারদের গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেন। অবাঙ্গালী অফিসারদের গ্রেফতার পর্ব শেষ হবার পরই তাদের কাছে ক্যাণ্টনমেণ্টের হত্যাকাণ্ডের খবর পৌঁছে।

 ৮ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একজন অফিসার পরে স্বীকার করেছিলেন, “ক্যাণ্টনমেণ্টের ঘটনার ব্যাপারে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। রেজিমেণ্টের তরুন অফিসারদের কয়েকজন তখনই ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের সৈনিকদের জীবন রক্ষায় ছুটে যেতে চান। অন্যরা ২১০ বালুচ রেজিমেণ্টকে আক্রমন করাকে আত্মঘাতী হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এই মতপার্থক্যের ফলেই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এই পর্যায়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে যাওয়া কিংবা ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা বোকামি হবে। এরপর ঐ রাতেই আমরা ষোলশহর ত্যাগ করে পটিয়ার দিকে অগ্রসর হই।”

 এদের এই পদক্ষেপ সম্পর্কে আমি আগে কিছুই জানতাম না। ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারে যাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম সেই ডাঃ জাফর ফিরে এলে সব জানতে পারলাম। কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে ডাঃ জাফরকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি এদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি?”

 “আপনার খবর তো ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট পৌঁছে দিয়েছি। তবু তারা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি” - ডাঃ জাফর জবাব দিলেন।

 “দয়া করে এক্ষুনি যান, গিয়ে ওদেরকে থামান। এখন সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। ওদের সাথে সম্মিলিতভাবে বাকী জায়গাগুলোও আমরা মুক্ত করতে পারবো। আজকের রাতই সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।”