পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৭২

৷৷ ঘেরাও ॥

 ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে নৃশংস অভিযানের প্রাথমিক সাফল্যে উৎফুল্ল ইয়াহিয়া তার বাহিনীকে ব্যাপক গণহত্যার ছাড়পত্র প্রদান করেন। পাকসেনারা তাদের অভিযান এলাকাগুলোতে প্রাণী বলতে যা কিছু পেয়েছে তাই নিধন করেছে এবং এসব স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে অবলিলাক্রমে। কিন্তু তবুও লোক এবং অস্ত্রবলে বলীয়ান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু এই প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা ছিলো দুঃসাধ্য, কারণ অস্ত্র চালনায় জনসাধারণের একদিকে যেমন কোন ট্রেনিং ছিলো না। তেমনি তাদের অস্ত্রগুলোও ছিলো পুরোনো আমলের। এদিকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত আমাদের বাঙালী সৈনিকরা যেখানেই সংগঠিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছেন সেখানেই শুরু হয়েছে কামান, ট্যাংক আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা শক্র পক্ষের সম্মিলিত আক্রমন। এই ধরনের বারংবার হামলার মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের গোলাবারুদের মজুতে টান পড়ে।

 এই অবস্থায় রেলওয়ে হিলের অবস্থান ত্যাগ করার জরুরী প্রয়োজন দেখা দিলো। তখন চারদিকেই শুক্রসেনা। ক্রমাগত ১ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর কামানগুলো আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আমাদেরকে ব্যাস্ত রাখে। এই সঙ্কটময় অবস্থায় আমি আমার সৈন্যদের কোতয়ালী থানা এলাকার দিকে সরে যেতে নির্দেশ দিই এবং সেখান থেকে ক্যাণ্টনমেণ্টের পেছনে সকলকে একত্র হতে বলি। গুলি বর্ষনের ছত্রছায়ায় যখন সকলেই স্থান ত্যাগ করে চলে যায় তারপরই আমি ঘাটি ত্যাগ করার জন্য পা বাড়াই। একজন তরুন কলেজ ছাত্রও আমার সাথে ছিলো। আমরা চলছিলাম কিন্তু মুখে কোন কথা ছিলো না। সমস্ত সকালটি ছিলো কুয়াশাচ্ছন্ন। বিমূড় বিষন্নতায় সমস্ত শহর যেন আচ্ছন্ন। রাস্তাঘাট ছিলো জনমানবশূন্য, মনে হচ্ছিলো মৃতের নগরী। শত শত বছর পরে মাটির তলা থেকে খুড়ে যেন নগরটিকে আবিস্কার করা হয়েছে। দূরে বন্দরে জাহাজের মাস্তল, ক্রেন, ওধারে অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম সবকিছুই একটির পর একটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। ভরাক্রান্ত হৃদয়ে পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই সা করে একটি বুলেট আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেলো। সাথে সাথে আমরা নীচু হয়ে চলার গতি বাড়িয়ে দেই।

 কদমতলী রেলক্রসিংয়ের কাছে নৌ-সেনাদের দুটি ট্রাক এ সময় অন্ধকারের মধ্যে অপেক্ষা করছিলো। আমি নিঃশঙ্কচিত্তে সামনে এগোচ্ছিলাম। কোন দেশ কি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না? বহির্জগতের কোন দেশ কি জানে না বাংলাদেশে এখন কি ঘটছে? আমাদের বেতার ঘোষনা কি তারা শুনেছে? এমনি নানা কথার ভীর আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কদমতলীর কাছাকাছি এসে এসব কথা ভাবতে ভাবতে যখনই রাস্তা পেরুতে গেছি তখনই দুটি গাড়ীর হেডলইটের তীব্র আলোয় আমার চোখ ঝলসে যায়। দুটি গাড়ি থেকেই সৈন্যরা লাফিয়ে নামতে থাকে। আমি সামনে একটি প্রাচীর দেখে সেটি পার হওয়ার জন্য দৌড় দিই শত্রুসৈন্যরাও গুলি বর্ষণ শুরু করে। একটি গুলি এসে আমার ডান হাতে ধরা এষ্টেনগানে লাগলে প্রচণ্ড ধাক্কায় সেটি ছিটকে পড়ে। আমি মুহুর্তে দেয়ালের উপর লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড বেগে ওপাশে গিয়ে পড়ি। তারপর লাফিয়ে হামাগড়ি দিয়ে আবার কখনো দৌড়ে চলতে থাকি। পেছনে শুনতে থাকি নৌ-সেনাদের এলোপাথার গুলিবর্ষনের শব্দ। তাদের দুঃখ, শিকার তাদের হাতছাড়া হয়ে গেলো।

 আমার বাম উরুতে তখন ভয়ানক যন্ত্রনা হচ্ছিলো, ভীষন রক্ত ঝরছিলো এবং ট্রাউজারের একটি অংশ হাটু পর্যন্ত ছিড়ে ঝুলছিলো। দেয়াল থেকে লাফিয়ে পড়ার সময়ই বোধ হয় কিছুতে লেগে এই জখম হয়েছে। কোতয়ালী থানায় পৌঁছে দেখি আমার লোকেরা সবাই সেখানে জড়ো হয়েছে। ৩” মর্টারগুলো তখন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে পড়েছিলো। কারন ওগুলোর কোনো শেল অবশিষ্ট ছিল না। পেট্রোলের অভাবে আমাদের কয়েকটি গাড়িও ফেলে আসতে হলো। আমি টেলিফোনে জনাব সিদ্দিকীতে মর্টারগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িসহ কাউকে পাঠাতে বললাম এবং সৈন্যদেরকে পুর্ব পরিকল্পিত জায়গায় গিয়ে প্রস্তুত হওয়ার জন্য নির্দেশ