পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১২০

 সেপ্টেম্বরের শেষে অথবা অক্টোবরের শুরুতে বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল পাঠানো হয় এবং আমিও তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। পাকিস্তান এইড কনসরটিয়ামের সভা শেষে আমি নিউইয়র্কে প্রতিনিধি দলে যোগ দিই। আমরা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করি এবং আন্দোলনের পক্ষে ৪৭টি সমর্থনসূচক বিবৃতি সংগ্রহ করি। কমবেশী সব দেশই আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং সবাই চাচ্ছিল একটি রাজনৈতিক সমাধান। এ সময়ের একটি বিশেষ ঘটনা আমাকে আলোড়িত করে। ১৪ই অক্টোবর ‘বেলমণ্ট প্লাজা’ হোটেলে রাত ৯টা/১০টার দিকে ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ মফিজ চৌধুরী এবং আরো কয়েকজন এক সাথে বসে আলাপ করছিলাম। এমন সময় খবর এলা যে মোনায়েম খান মারা গেছেন। আমরা আনন্দে হর্ষধ্বনি করে উঠি। এমন সময় হঠাৎ করে মল্লিক সাহেব গম্ভীরভাবে বললেন যে, দেখো, যুদ্ধ আমাদের কি রকম করে ফেলেছে। একটি মানুষের মৃত্যুতে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠি।

 ৮ই নভেম্বর পাকিস্তানে সব ধরনের অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হয়। ১০ই নভেম্বর “পাকিস্তান অর্থনৈতিক সাহায্য” বিল পাস হয়। এ বিলে বলা হয় যে, যতদিন পর্যন্ত রিফিউজিদের ফিরে যাবার মতো অবস্থা সৃষ্টি না হবে ততদিন কোন অর্থনৈতিক সাহায্য করা হবে না।

 আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল “হেলষ্টসকি প্রস্তাব“। এই প্রস্তাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।

 নভেম্বরের শেষে বর্ডার এলাকায় গোলাগুলি শুরু হবার পর বিভিন্ন মহলে অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেতে লাগলো। তখন সবাই চিন্তা করছিল কিভাবে রক্তক্ষয় বন্ধ করা যায়। সেটা বাঙ্গালীদেরই হোক বা পাকিস্তানী বা রাজাকারেরই হোক। এছাড়া পুনর্বাসন নিয়েও চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। এমনকি মুজিব নগরের নেতৃত্ব একটি স্বাধীন দেশ পরিচালনা করতে পারবে কিনা তা নিয়েও কিছু কিছু প্রশ্ন উঠে। আমার মনে পড়ে সিনেটর স্যাক্সবি, যিনি এই আন্দোলনের একজন গোঁড়া সমর্থক ছিলেন, আমাকে একদিন ডেকে বললেন “আমাকে আশ্বাস দাও যে, দেশ স্বাধীন হলে তোমরা তা পরিচালনা করতে পারবে”।

 ডিসেম্বর মাসে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমরা এক প্রকার নিশ্চিত ছিলাম যে যুদ্ধে আমরা জয়ী হবই। যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে একটা ঘটনার উল্লেখ করা যায়। অক্টোবর মাসের দিকে সারওয়ার মুর্শেদ খানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান-এর পক্ষ থেকে চিঠি আসে। এত ছিল বিমান বাহিনী গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং ভারী কামান-গোলার একটি বিশদ বিবরণ কিন্তু এই বিবরণ বা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তালিকা খুবই উদ্ভট ছিল যেহেতু এই সব সংগ্রহ করা ছিল অসম্ভব এবং এর জন্য যে অর্থ প্রয়োজন হতো তাও আমাদের ছিল না। অবশ্য যুদ্ধে ভারত যে আমাদের সাহায্য করবে তা আমরা সহজেই অনুমান করেছিলাম। জুন মাসে বোষ্টনের ফিরোজের উদ্যোগে বেশ কিছু কম্যুনিকেশন যন্ত্রপাতি আমরা মুজিব নগরে পাঠাই। বোধ হয় এতেই ধারণা হয়েছিল যে ভারী অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতেও আমরা সক্ষম হব। নভেম্বরের শেষেই মনে হয়েছিল যে সরাসরি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী কিন্তু পাকিস্তান যে সেই যুদ্ধ শুরু করবে এমন নির্বুদ্ধিতার আশংকা আমরা মোটেই করিনি।

 যুদ্ধকালীন অবস্থায় কিছু পাকিস্তানী আমাদের মুজিব নগর সরকারের সাথে একটি সমঝোতায় আসতে চেষ্টা করে। তাদের কয়েকজন জানায় যে, এই প্রস্তাব ভুট্টোর মস্তিষ্কপ্রসূত। তারা মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হবে যদি শেখ মুজিব সরাসরি জাতিসংঘে এসে পাকিস্তানের ভূ-খণ্ড থেকে সব বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান এবং তার আহ্বানে ভারত সাড়া দেয়। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় এসে বাঙ্গালীদের সব দাবী মেনে নেবে। প্রস্তাবটি অত্যন্ত চতুর বলে আমাদের মনে হয়েছিল। আমরা উত্তরে জানাই যে সর্বশক্তি বলতে আমরা ভারত এবং পাকিস্তান উভয়কে বুঝি। ছেড়ে যেতে হলে উভয়কে যেতে হবে একসাথে। কিন্তু এই আলোচনা সরকারী পর্যায়ে পৌঁছুবার আগেই বন্ধ হয়ে যায়।