পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১২৮

 অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে অর্থাৎ ২৫শে মার্চ সমগ্র চট্টগ্রাম জেলায় সরকারী, বেসরকারী অফিস আদালত ও স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে। এ সময় জেলা সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে চট্টগ্রাম জেলার সকল মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার, জোয়ান ও আনসারদিগকে একত্রিত করা হয় এবং বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ জোগাড় করা হয়।

 ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টে অবস্থানরত ‘সোয়াত’ জাহাজ হতে সকাল ৮ ঘটিকার সময় পাকসামরিক জোয়ানরা অস্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ নামানোর জাজ শুরু করে। আমি এম, এ, হালিমের কাছ থেকে এ সংবাদ পাই। সংবাদ পাওয়ার পর আমি নিউ মোরিং পোর্টে চলে যাই। পরে টিম ট্রাফিক ম্যানেজার গোলাম কিবরিয়া, তৎকালীন পুলিশ সুপার ও ডেপুটি কমিশনারের সাথে অস্ত্র না উঠানোর ব্যাপারে আলাপ করি কিন্তু তারা তাদের অপারগতার কথা জানান। তবে পোর্ট ট্রাস্টের শ্রমিক নেতা নবী মিস্ত্রী ও চিটাগাং ষ্টীল মিলের ম্যানেজার জাহেদ সাহেব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নামানোর ব্যাপারে বাধা দেয় ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সার্বিক সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। তাৎক্ষণিকভাবে নবী মিস্ত্রী মাইক দ্বারা শ্রমিক ও যুবকদের যার যা আছে তা নিয়ে নিউ মোরিং পোর্টে ঘেরাও করার আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার ছাত্র, শ্রমিক জনতা নিউ মোরিং পোর্ট ঘেরাও করে ফেলে। পাক-বাহিনীও বাধা দেয়ার জন্য কামান ও মেশিনগান তাক করে রাখে। বিকেলে অবস্থা বেগতিক দেখে ফায়ার ব্রিগেড ময়দানে উত্তেজিত জনতাকে নিয়ে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। উক্ত জনসভায় সালেহ আহমদ (এম, এন, এ), মোশারফ হোসেন (এম, পি, এ), এম, এ মজিদ (এম, এন, এ) বকতৃতা করেন। আমি সভাপতির ভাষণ দেই। সেখানে উত্তেজিত জনতাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাস হতে পোর্ট ট্রাস্ট পর্যন্ত পথে বেরিকেড সৃষ্টি করার আহ্বান জানানো হয়। অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কয়েক হাজার লোক শহরের ও শহরতলীর সকল পথে বেরিকেড সৃষ্টি করে। উদ্দেশ্য হলো যে পাকবাহিনী কোন অবস্থাতেই যেন অস্ত্র বা গোলাবারুদ ভর্তি ট্রাক বা গাড়ি সেনানিবাসে নিয়ে যেতে না পারে। এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে আমি ২৪শে মার্চ রাত্রে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে টেলিফোনের মাধ্যমে জানাই। উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পাক হানাদার বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। গুলিবর্ষণে প্রায় ৩০ জনের মৃতু ঘটে। ২৪শে মার্চে রাত্রে পাকবাহিনী বেরিকেড ভাঙ্গতে সমর্থ হয় এবং বোঝাই ট্রাক নিয়ে সেনানিবাসের দিকে অগ্রসর হয়।

 ২৫শে মার্চ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ ও জেলা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্টিত হয়। সে সময় সংবাদ পাওয়া গেল যে কুমিল্লা সেনানিবাস হতে একটি আর্মি কনভয় (Army Convoy) চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ সংবাদ পেয়ে মিরেরশরাই থানার এম, পি, এ জনাব মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের সুভপুর সেতু নষ্ট করে দেয়ার জন্য পাঠানো হলো। কিন্তু কোন Explosive না থাকায় এ প্রচেষ্টা আংশিকভাবে সফল হয় মাত্র।

 ২৫শে মার্চ মাত্রে আবার আমরা এম আর সিদ্দিকী সাহেবের বাড়ীতে চট্টগ্রামের সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মিলিত হই। রাত ১০টার সময় শেখ মুজিবুর রহমান এম, আর, সিদ্দিকী সাহেবের নিকট একটি জরুরী সংবাদ দেন। সংবাদটির মূল বিষয়বস্তু ছিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

 তারপর আমি ও সভার সকল সদস্যবৃন্দ ডেপুটি কমিশনার সাহেবের বাংলোতে আসি এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রেরিত সংবাদের কথাও বলি। কিন্তু ডেপুটি কমিশনার বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করেন। সেখানে পুলিশ সুপার শামসুল হক সাহেব উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর আন্তরিকতা ও সহানুভূতি প্রকাশ করলেন।

 ডেপুটি কমিশনার হতে সাড়া না পেয়ে আমরা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যগণ স্টেশন রোডস্থ রেষ্ট হাউসে আসি এবং স্থির করা হয় যে প্রতিরোধ আন্দোলনকে বাস্তবায়িত করার জন্য কয়েকজন সদস্য সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট তৈরী করে শহরের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৎক্ষণাৎ প্রত্যেক সদস্য স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হন।