পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৩২

লোকারণ্য। অমিতাভ দাশগুপ্ত (ভারতীয় বামপন্থী নেতা) এদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং তিনি চেষ্টা করেন আমকে এদের সাথে কাজ করার সুযোগ করে দিতে কিন্তু তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেহেতু জানা যায় আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার নাই।

 এরপর মৈত্রী দেবীর সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি এই পর্যায়ে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। জানা যায় যে একটি বেতার কেন্দ্রে প্রতিষ্টার চেষ্টা চলছে। তাঁরই উদ্যোগে প্যাড ছাপানো হয়। ষ্ট্যাম্প ইত্যাদিও প্রস্তুত করা হয়! আরও খবর পাওয়া যায় যে বিএসএফ-এর মাধ্যমে একটি বেতার ট্রান্সমিটারও পাওয়া যাবে।

 এপ্রিলের শেষের দিকে খবর আসে যে ‘জয় বাংলা’ নামে একটা পত্রিকা বার হচ্ছে। এর অফিস বালু হাক-কাক লেনে। এও খবর শুনি আবদুল মান্নান এই পত্রিকার দায়িত্বে আছেন। জহির রায়হান তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন কিন্তু তাঁকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করা হয়েছে। যা হোক বেতার কেন্দ্রের ব্যাপার নিয়ে আমরা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ি। শামসুল হুদা চৌধুরী, মোস্তফা মনোয়ার, কামরুল হাসান, এম আর আখতার মুকুল এবং আমি একটি কমিটি কঠন করি। সার্কাস এভিনিউ-এর একটি বাসায় আমরা বসতাম। ঠিক হয় যে জামিল চৌধুরী এবং মোস্তফা মনোয়ার বাজেট এবং কর্মী তালিকা তৈরী করবেন। তাঁরা তা প্রস্তুত করেন এবং হিসেব দাঁড়ায় মাসিক ১৮,০০০ টাকা সব খরচ ধরে। কিন্তু আওয়ামী লীগ মহলে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বাজেট ধরা হয়েছে দৈনিক ১৮,০০০ টাকা। এই সব ঘটনার পর আমরা বেতার কেন্দ্র থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি নিজের ইচ্ছায়।

 আমি আবার ঢাকায় আসি এবং কয়েকজনকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাই। এর মধ্যে পরিচিত হচ্ছেন বেনু এবং শাহীন মাহমুদ। কলকাতায় যাবার আগে তাদের বিয়ে দিয়ে তারপর নিয়ে যাই।

 ততদিন পশ্চিম বঙ্গ শিল্পী সাহিত্যিক সহায়ক সমিতি গঠিত হয়েছে। দিপেন বিশ্বাস ছিলেন এর সংগঠক। অর্থও সংগৃহীত হয় এবং প্রায় সব শিল্পী-সাহিত্যিকের সাথে জড়িয়ে পরেন। যে সাংস্কৃতিক দল তৈরি হয় তার সভাপতি হন সনজীদা খাতুন, আমি হই পরিচালক। এর নাম দেয় হয় ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। মে মাসে এটা গঠিত হয়। স্কোয়াডের সদস্য সংখ্যা ছিল একশজনের মত।

 ১৪৪, লেলিন সরণীতে পি, পি, আই অফিসের একটি কক্ষে রিহার্সাল হোত। তিরিশ দিনের প্রতিদিনই রিহার্সাল হয়। ৩রা জুন প্রথম অনুষ্ঠান হয় রবীন্দ্র সদনে। শাহরিয়ার কবির রচিত ‘রূপান্তরের গান’ নামে একটি গীতি আলেখ্য। আলোকসজ্জা ও মঞ্চ সাজাবার দায়িত্বে ছিলেন মোস্তফা মনোয়ার। যদিও আমাদের সামর্থ্য সীমিত ছিল তবুও অনুষ্ঠান কল্পনাতীতভাবে সফল হয়। বহু সুধীজনের সামনে আমাদের এই অনুষ্ঠান প্রচুর প্রশংসা লাভ করে। আমাদের মনোবল দারুণ বেড়ে যায়। এরপর আমরা পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান করে বেড়াতে থাকি। যে ডাকত আমরা যেতাম। পুজোর সময় প্রচুর অনুষ্ঠান করি। কলা মন্দিরেও আমাদের অনুষ্ঠান হয়।

 তবে আমাদের প্রধান কাজ ছিল ক্যাম্পে ক্যাম্পে সংগীত পরিবেশন করা। বেনু এবং শাহীন মাহমুদ দলের নেতা ছিলেন। সকাল বেলা আমাদের একটি গাড়ীতে যতজন ধরতো ততজনকে পাঠানো হোত একটি ক্যাম্পে। সারাদিন প্রোগ্রাম করে তারা ফিরত আবার পরদিন যাবার জন্য। অনুষ্ঠান চলতো এক ঘণ্টা ধরে। আমার অনুমান ২৫০টিরও বেশী অনুষ্ঠান করা হয়।

 সেপ্টেম্বর মাসে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রথম, বিভিন্ন শিল্পী ও সাহিত্যকদের একত্রে করে একটি সংগঠন করা হয়। এর নাম দেয়া হয় ‘লিবারেশন কাউন্সিল অফ দি ইনটেলিজেণ্টসিয়া’। এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক এ, আর, মল্লিক। জহির রায়হান এবং আলমগীর কবীর এই সংগঠনের বেশ সক্রিয় ছিলেন।