পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৩৬

সভাপতিত্বে বামপন্থীদের এক নীতিনির্ধারণী সভা হবে, আমি যেন অন্য সকলকে জানিয়ে নিজেও চলে আসি। সভা নির্দিষ্ট ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে আমাদের আকাঙ্ক্ষিত নেতা মওলানা ভাসানী উপস্থিত ছিলেন না। জানানো হয় যে, মওলানা ভাসানীকে ভারত সরকার সীমান্ত এলাকা থেকে নিয়ে গেছেন। গ্রেফতার কিনা চানা যায়নি। ফলে সভায় উৎসাহ সঞ্চারিত হতে পারেনি। একটি মাত্র সিদ্ধান্ত সেখানে গৃহীত হয় যে, আমরা বামপন্থীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করবো। পরবর্তী সভার তারিখ নির্ধারিত হয় ২১ ও ৩০ মে এবং এর স্থান নির্বাচন ও আয়োজনের দায়িত্ব অর্পিত হয় দেবেন সিকদার ও ন্যাপ সম্পাদক মশিউর রহমানের ওপর। এই সভায় আমি ছাড়া উপস্থিত অন্যরা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ, অমল সেন, মশিউর রহমান, দেবেন সিকদার, আবুল বাশার, ডাঃ মারুফ হোসেন, ডাঃ সাঈফ-উল-দাহার এবং নজরুল ইসলাম। আমরা ফিরে আসি দেশের অভ্যন্তরে।

 পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়, কিন্তু এতেও মওলানা ভাসানী উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর লেখা একটি চিঠি পড়ে শোনানো হয় যাতে তিনি লিখেছিলেন যে, বাইরে বেরোনার ব্যাপারে তাঁর অসুবিধা আছে, তিনি ভালো আছেন।

 মওলানা ভাসানী আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন, তাঁর নির্দেশ ছিল আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে গণচীনসহ কয়েকটি রাষ্ট্রের প্রধানদের নিকট তিনি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন সমর্থন চেয়ে। মওলানা ভাসানীর এই চিঠিটি এসেছিল ভারতের একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের মাধ্যমে। এ প্রসংগে বলা দরকার যে কাগজে-কলমে না হলেও পরোক্ষভাবে সুকৌশলে মওলানা ভাসানীকে বন্দী দশায় রাখা হয়েছিল।

 এ সভায় সভাপতিত্ব করেন দিনাজপুরের কৃষক নেতা শ্রবরোদা ভূষণ চক্রবর্তী। বিস্তারিত আলোচনা শেষে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন দেবেন সিকদার (পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টি), নাসিম আলী (বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি-হাতিয়ার), অমল সেন (কমিউনিষ্ট সংহতি কেন্দ্র), ডাঃ সাইফ-উদ-দাহার (কমিউনিষ্ট কর্মী সংঘ) এবং আমি (কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি)। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের প্রতি ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানানো হয় এবং এ ব্যাপারে যোগাযোগের দায়িত্ব লাভ করি আমরা। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় ঘোষণাটি ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যথেষ্ট প্রচার লাভ করেছিলো। এতে বিভেদের নীতি পরিহার করে সকল বামপন্থী ও দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহকে আওয়ামী লীগের সাথে একযোগে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই-এ অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছিলো। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ জুন জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণার কপিসহ আমি, রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনো কলকাতায় অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করে স্বাধীনতাযুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করি। ধৈর্য্য ও সহানুভূতির সাথে বক্তব্য শুনলেও তিনি আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের মুক্তিবাহিনীতে আমাদের কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করেন। কারণ হিসেবে তিনি হক-তোয়াহার নেতৃত্বাধীনে কমিউনিষ্টদের শ্রেণী সংগ্রামের এবং স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতার উল্লেখ করেন, তাদের প্রচারপত্রের প্রসংগও টেনে আনেন। আমরা বলি যে হকতোয়াহারা যা করছেন তা নিজেদের দায়িত্বেই করছেন, এর সাথে বামপন্থীদের বিরাট অংশটি আদৌ জড়িত নয়। আপনি কেবল আওয়ামী লীগের সম্পাদকই নন, দেশেরও প্রধানমন্ত্রী এবং এজন্যেই জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামে যে কাউকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া আপনার কর্তব্য। এ প্রসংগে জনাব তাজউদ্দিন জানান যে তাঁকে সিদ্ধান্তের আগে গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে এবং আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার অনুপস্থিতিতে নির্ভর করতে হবে ভারত সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর। এই পর্যায়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়, এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদের উপস্থিতি সে অপ্রিয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আমরা মর্মাহত হয়ে ফিরে আসি।