পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৩৭

 দেশে ফেরার পথে জুনের মাঝামাঝি আগরতলায় আমাকে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আটক করে নিয়ে যায় শিলং-এর একটি ডাক বাংলোয়। সেখানে আমাকে সাত দিন রাখা হয়। ঘটনাটিকে আমি গ্রেফতার বলবো না, কেননা, কোন খারাপ আচরণ আমার সাথে করা হয়নি। কিন্তু সাত দিনব্যাপী অবিরাম প্রশ্নের মাধ্যমে আমাকে ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়। আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান মিঃ সুব্রামনিয়াম। তিনি অবশ্য সমগ্র ব্যাপারটিকে ‘নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা’ হিসেবে বোঝাতে চেয়েছিলেন। এই আলোচনায় দেশের অতীত ও বর্তমান রাজনীতিতে বামপন্থীদের ভূমিকাসহ বিভিন্ন প্রসংগ এসেছিলো। তিনি বারবার আওয়ামী লীগ এবং ভারতের প্রতি বামপন্থীদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। আমি বলেছিলাম; এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান সমস্যা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী; এর বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে চাই, আওয়ামী লীগের সাথে মতপার্থক্যসমূহ এখন তুলে ধরবো না—তাদের সাথে আমাদের সমস্যাসমূহের মীমাংসা আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতে করবো, যুদ্ধের মধ্যে বা ভারতের অভ্যন্তরে নয়। ভারতের সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বা সম্ভাবনার প্রসংগে আমি বলেছিলাম: ভারতের পক্ষে সেটা উচিত হবে না, আমরা বাংলার মাটিতেই শত্রুদের খতম করবো। স্বাধীনতাকে আমরা ছিনিয়ে আনতে চাই, কারো অনুগ্রহে পেতে চাই না।

 অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সাথে ব্যর্থ আলোচনার পর আমরা নিজেদের উদ্যোগে যেখানে যতটুকু শক্তি নিয়ে যেভাবে সম্ভব স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখি। মুজিব নগর সরকারকে আমরা অস্বীকার করিনি, কিন্তু তাই বলে প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগও রাখিনি, সহযোগিতাও পাইনি। সরকার সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন ছিল, সমালোচনা ছিল, কেননা তারা আওয়ামী লীগের বাইরে বিশেষ করে বামপন্থীদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রশ্নে অযৌক্তিক সংকীর্ণ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এই নীতি আমাদের হতাশ করেছিল। এজন্যেই আমরা নিজেদের উদ্যোগে লড়াই চালিয়েছিলাম।

 স্বাধীনতাযুদ্ধকালে আমাদের সংগঠনের নীতি ছিল দুটি:

 ১। যেখানে সম্ভব বেংগল রেজিমেণ্ট, ই পি আর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারী মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে তাদের নির্দেশ মান্য করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এবং (২) কোথাও তেমন বাহিনী না থাকলে, কিংবা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে যোগদান সম্ভব না হলে আলাদাভাবে ‘গেরিলা ফৌজ’ গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনা করা। উল্লেখ্য যে, আমাদের সংগঠনের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর নাম ছিলো ‘গেরিলা ফৌজ’। এর গঠন প্রণালী ছিল-পাঁচ থেকে সাতজন নিয়ে একটি গ্রুপ, কয়েকটি গ্রুপ নিয়ে একটি স্কোয়াড এবং কয়েকটি স্কোয়াড নিয়ে গঠিত হতো এক একটি আঞ্চলিক ইউনিট। এ ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ ২৫ মার্চের জনসভাতেই ঘোষণা করা হয়েছিল।

 দেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই আমাদের কর্মীরা মুক্তিবাহিনীর সাথে একযোগে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেটা সম্ভব না হওয়ায় বিশেষ কয়েকটি এলাকায় গেরিলা ফৌজ গঠন করতে হয়। এই এলাকাগুলি ছিল নিম্নরূপ:

 ১। ঢাকা জেলার শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুর ও কালিগঞ্জ নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে গেরিলা ফৌজের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। এই এলাকায় যুদ্ধকালে অন্য কোন বাহিনী গঠিত হয়নি, এমনকি রাজাকার বা বদর বাহিনীও গঠিত হতে পারেনি। প্রসংগত, একটি দুঃখজনক ঘটনা ছিল: মাঝে মাঝে মিথ্যে রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে এখানে মুক্তি বা মুজিব বাহিনীকে পাঠানো হতো আমাদের যোদ্ধাদের নিরস্ত্র করার জন্য। প্রায় ক্ষেত্রেই উল্টোটি ঘটতো, কিংবা গেরিলা তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে আগত যোদ্ধারাও দলভুক্ত হয়ে যেতেন। এই এলাকায় আমাদের বিখ্যাত কমাণ্ডার ছিলেন পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য নেভল সিরাজ। উল্লেখ্য যে, যুদ্ধকালে এই এলাকাটি আমাদের সংগঠনের হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।