পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২১৮

 সশস্ত্র প্রতিরোধ ভূমিকা পালনের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। আশুগঞ্জে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়লে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে নেতৃবৃন্দের থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং প্রকৃতপক্ষে এলাকার জনগণ তাঁদেরকে ক্রমে সীমান্তের দিকে নিয়ে যায়। সীমান্ত অতিক্রম করার আগেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিভিন্ন জেলা সংগঠনের জন্য নির্দেশ দিয়ে ক্যাডার পাঠাতে সক্ষম হন।

 পাকবাহিনীর আক্রমণ, নির্বিচার গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ প্রভৃতির মুখে সীমান্ত এলাকার জেলাগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ ভারতে চলে যায়। আমাদের পার্টির বহু কর্মী-সমর্থক সপরিবারে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। অন্যান্য দলের রাজনৈতিক কর্মীরাও চলে যায়। আমাদের হিসেবে আমাদের পার্টির নেতা, সমর্থক ও কর্মীগণ এবং তাদের পরিবারবর্গ মিলিয়ে ৬ হাজার নরনারী পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মেঘালয় এই তিনটি ভারতীয় রাজ্যে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময় গোটা পার্টির সংগঠন সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন জেলায় দেশের মধ্যে আমাদের কিছু কমরেড থেকে গিয়েছিলেন। প্রবাসে সকলের জন্য আশ্রয়, খাদ্য প্রভৃতির ব্যবস্থা করা এবং ভিতরে বাইরে সকল পর্যায়ের পার্টি সংগঠনের সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করা এবং সংগঠন গুছিয়ে নেয়া এবং সর্বোপরি কালবিলম্ব না করে গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা প্রভৃতি অত্যন্ত দুরূহ কাজ তখন পার্টির সামনে ছিল। আমাদের নেতা-কর্মীদের সব কিছু দৃঢ়তার সাথে হাসিমুখে সহ্য করা, অসম সাহসিক প্রয়াস এবং ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টিসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিক শক্তির সাহায্যের ফলে অতি অল্প সময়ে আমরা কাজগুলো গুছিয়ে তুলি। এ-পর্যায়ে আমাদের সংগঠিত হওয়ার কাজের ধারাগুলো ছিল সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ (ক) কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়েনের যৌথ ক্যাম্প স্থাপন-ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের সহায়তায় সীমান্তবর্তী ভারতের তিনটি রাজ্যেই এবং তাদের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা। (খ) দু'ধরনের ক্যাম্প ছিল-পার্টির বয়স্ক সদস্যদের পরিবারবর্গসহ আশ্রয়ের জন্য এবং তরুণদের জন্য যাদেরকে লড়াইয়ের উপযুক্ত মনে করা হবে ও ট্রেনিং দিয়ে পাঠানো হবে। (গ) ক্রমশ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা গ্রহণ এবং আমাদের ক্যাম্পে সংগঠিত তরুণদের সরকারের মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং-এ প্রেরণ। (ঘ) আমাদের পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের মিলিত একটি নিজস্ব গেরিলা বাহিনী গঠন। এতে প্রথমে ট্রেনিং দানে প্রভূত ‘টেকনিক্যাল অসুবিধায় পড়তে হয়েছিলেন। কিন্তু পরে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে তা গঠন করা সম্ভব হয়। (ঙ) আগরতলায় এবং মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে কোলকাতয়াও কেন্দ্রী কমিটির কার্যালয়ে গঠন করে কাজ করা। (চ) আমাদের নিজস্ব গেরিলা বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই দেশের ভেতরে যুদ্ধ করতে পাঠানো। (ছ) দেশের ভেতরের সমরেডদের সঙ্গে যোগযোগ স্থাপন এবং অনুপ্রবিষ্ট গেরিলাদের তাদের সহায়তা গ্রহণ। (জ) আমদের ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা তরুণদের রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা। (ঝ) কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করে তা সকল ক্যাম্পে, শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ও দেশের ভেতরেও প্রচারের ব্যবস্থা করা।

 আমাদের পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীতে ৫ হাজার তরুণকে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানো হয়। এছাড়া আমাদের প্রচেষ্টায় আমরা ১২ হাজার তরুণ সংগ্রহ ও সমাবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিবাহিনীতেই পাঠাই। অর্থাৎ আমরা মোট ১৭ হাজার তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং ও যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করি। তবে যুদ্ধের পরে এই তরুণরা অনেকে লেখাপড়া, অনেকে চাকরি, কৃষিকাজ ও ব্যবসা প্রভৃতি নিজ নিজ পেশায় ফিরে যায় এবং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ছিল না।

 ভারতে যাওয়ার পরই ১৯৭১ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় কমিটি মিলিত হয়ে এর প্রথম বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক চরিত্র, সংগ্রামের শক্তি এবং শত্রুমিত্র প্রভৃতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করে একটি দলিল গ্রহণ করেছিল। ঐ দলিলে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক ধরনের শাসন-শোষণের স্বরূপ নির্দেশ করে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামকে জাতীয় স্বাধীনতা এবং মুক্তির সংগ্রাম বলে মূল্যায়ন করা হয়েছিল। মূল্যায়নে বলা হয়েছিল যে স্বাধীনতার জন্য জনগণের দৃঢ় একতা এবং মুক্তিবাহিনীর বীরত্ব ও ত্যাগ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান শক্তি। এবং প্রতিবেশী ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবির, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন ও