পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৯৬

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

জন্যে উপযোগী করে তোলাই এসবের লক্ষ্য। ছেলেরা সর্ববিধ কাজ নিজেরা করে। পানি আনা, রান্না করা, জ্বালানী সংগ্রহ, শিবির প্রহরা সবই নিজেদের করতে হয়।

 কঠোর পরিশ্রমের সাথে সাথে খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রামের ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোরতা পালান করা হয়। সকাল বেলায় নাশতা একট আটার রুটি; সাথে কোনদিন সবুজ চা, বা অল্প ভাজি। দুপুরে বা সন্ধ্যায় এক বাসন ভাত, সাথে সামান্য ডাল বা তরকারী। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মাসান্তে অর্ধেক ডিম বা দু’এক টুকরা মাংস বা মাছ পাওয়া যায়।

 ছেলেরা থাকে বাঁশের মাচায়। কেউ এর ওপর সতরঞ্চি বা চাদর বিছায়। বালিশ অনেকের নেই। বালিশের অভাবে কেউ কেউ মাথার নীচে কাপড়ের পুটুলি রাখে বা খাওয়ার প্লেটটি উপুর করে দেয়। মশারী অধিকাংশের নেই। পানি খাওয়ার জন্যে তারা ব্যবহার করে মগ, কেটলি বাঁশের চোঙগা বা মর্টারের খোল। টিলার নিচে একটি টিউবওয়েল আছে। প্লান করে নালাতে। এতে পানি থাকে কখনো এক বিঘত, কখনও এক হাটু। বৃষ্টির দিনে নালার জল কর্দমাক্ত, অন্য সময় নির্মল।

 সকাল সাতটায় শিবিরের কাজ শুরু। পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীতের পর ব্যায়াম শিক্ষক ক্লাশ নেন। পুরো এক ঘণ্টা চলে প্যারেড ও দৈহিক অনুশীলন। তারপর সামন্য বিরতি ও নাশতা। নাশাতার পর আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর শিক্ষাদানের ক্লাশ। বেলা দশটায় রাজনীতির ক্লাশ, এগারোটার দিকে পূর্ণ বিরতি।

 বিকালের দিকে শিবির পুনরায় জেগে ওঠে। বেলা চারটে হতে প্যারেড ও দৈহিক ব্যায়াম করে খেলাধুলা শুরু হয়। শিবিরে আছে দুটো ভলিবল। সন্ধ্যার দিকে ছেলেরা আসর জমায় অফিসের সামনে খোলা যায়গায়। দুটো জারুল গাছকে ঘিরে বাঁশের মাচা তৈরি হয়েছে। তার ওপর তারা বসে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটা থেকে। অনেকেই অপেক্ষা করে চরমপত্রের জন্যে। এরপর ক্যাম্প নির্জন ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে।

 শিবিরের কাজকর্মে চাঞ্চল্য আসে যেদিন কোন বিখ্যাত অতিথি আসেন বা রিক্রুটের জন্যে সামরিক কর্তার আগমন গটে। এমপি বা এমএনএ-রা আসেন, ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেন, আশ্বাসের কথা শোনান। রিক্রুটিং অফিসার আসেন, ট্রেনিং-এর জন্যে ছেলে নির্বাচন করেন। দল বেঁধে ওরা চলে যায় আসামে বা দিল্লীতে। বাকি ছেলেরা অশ্রুসজল চোখে তাদের বিদায় জানায় আর ভাবে কবে নিজেদের সুযোগ আসবে।...

 ক’দিন পরে আমি সেলিম ভাইয়ের কাছে বললাম আমার প্রশিক্ষণের কথা। এমনিতেই কর্মহীন জীবনে বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। তিনি আমাকে একটি বড় আশা দিলেন। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে আরো বড় একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে বিশেষ কারো কারো ক্ষেত্রে। দেরাদুনে জেনারেল ওভানের নেতৃত্বে তাদের ট্রেনিং দেয়া হয়। এদর নাম বেঙ্গল লিবারেশন আর্মি। যুদ্ধান্তে এদের মধ্য থেকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা হবে। তিনি ভরসা দিলেন যে আমাকে ঐ দলে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ তিনি এনে দিবেন। আমি আশায় আশায় থাকি।

 হাতিমারা এলাকায় যুদ্ধের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল। প্রায়ই তিনি বাদল ও আমাকে ডেকে পাঠাতেন তাঁর তাবুতে। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভক্ত ও মাওলানা ভাসানীর অনুসারী। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতাম বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে। রাতটা ওখানে কাটিয়ে ফিরতাম পরদিন।

 কিছুদিন পরে ফজলুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও আমার জ্ঞাতি ভাই ফিরে এল দেরাদুন ট্রেনিং নিয়ে। আমাদের ক্যাম্পেই উঠল। সে জানতে চাইল বাড়ির খবরাখবর; আমি জানতে চাইলাম তার ট্রেনিং এর খবর। আমি ঐ ট্রেনিং-এ যেতে চাই শুনে সে আতংকিত হল। বলল এই ট্রেনিং শুধুমাত্র বিশ্বস্ত বাছাই করা।