পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩১৩

 আমি স্বাধীনতার সংগে সংগে দেশে ফিরতে পারিনি। তখন সকলেই দ্রুতগতিতে দেশমুখী হচ্ছিলেন তাই ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইন্স এ পর্যায়ক্রমে সকলের হয়েছিল। আমি জানুয়ারি মাসের ১১তারিখে দেশে ফিরেছি। দেশে ফিরে মনে হয়েছিল একটি নতুন প্রত্যুষে আমি যেন নতুন সূর্যোদয় দেখেছি। ঠিক সেই মুহুর্তের মানসিক অবস্থার কথা ব্যাখ্যা করতে পারব না। একটি নতুন চৈতন্যের প্রান্তরে আমি নিজকে উপস্থিত দেখে অভিভূত হয়েছিলাম।

সৈয়দ আলী আহসান
১৯এপ্রিল, ১৯৮৪


ডঃ অজয় রায়

 ২৫ শে মার্চের কাল রাত্রিতে ইয়াহিয়ার সামরিক চক্রের চাতুরিতে ঢাকায় শিল্পী কামরুল হাসান অঙ্কিত ইয়াহিয়ার জানোয়ার মুখ উন্মোচিত হল। শুরু হল অপারেশন সার্চলাইট, হল নয় মাসব্যাপী গণহত্যাযজ্ঞের উদ্ধোধন- বাংলার রক্তে, বাঙালীর রক্তে।

 কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিকট কানফাটা গর্জনে সে রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গিয়িছিল। প্রচণ্ড শব্দে ভেঙ্গে গিয়েছিল জানালার কাঁচ। আর্ত মানুষের অসহায় চীৎকারকে ছাপিয়ে সারারাত ধরে শুনছিলাম আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ, ট্রাক ও ট্যাঙ্কের পদাচরণ ধ্বনি। শঙ্কিত চিত্তে আমরা অপেক্ষা করছিলাম যে কোন মুহুর্তে পৈশাচিক বাহিনীর উপস্থিতি। বুঝতে কষ্ট হয়নি সারারাত ধরে কিসের হোলি উৎসব- কাদের রক্তে ঢাকার রাজপথ পরিণত হচ্ছে রক্ত নদীতে।

 যা আমরা আশঙ্কা করেছিলাম অবেশেষে তাই ঘটল। সারাদেশের সাথে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও অপেক্ষা করছিলাম উদ্বেগব্যাকুল চিত্তে ইয়াহিয়া মুজিবের আলোচনার ফলাফল। অসহায়ভাবে লক্ষ্য করছিলাম ইয়াহিয়া সরকারের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি। আমরা আশঙ্কা করছিলাম এ ধরেনের এক ভয়ংকর পরিস্থিতি, অনুমান করেছিলাম আসন্ন গণহত্যার পূর্বাভাষ। তাই মার্চের ২২/২৩ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও দেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে গণহত্যার পূর্বাভাষ জানিয়ে আমরা প্রেরণ করেছিলাম জরুরী বার্তা ইউ, এন ও-র সেক্রেটারি জেনারেল ও বিশ্বের অন্যান্য নেতৃবর্গের কাছে। আমাদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না।

 সে রাত্রে পাকিস্তানের বীর জোয়ানেরা কত বাংগালীকে হত্যা করেছিল তার সংখ্যা হত্যাকারীরা ও বলতে পারবে না। শুধু এটুকু জানি- রাজারবাগে শত শত পুলিশ প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে নীলক্ষেত কমলাপুর এলাকার শত শত বস্তিবাসী, আত্মাহুতি দিয়েছে জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলের অসহায় ছাত্ররা, রাস্তার অসহায় নিরস্ত্র মানুষ আর রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড তৈরীরত শত শত সাধারণ মানুষ ও অকুতোভয় শ্রমিকেরা।

 সব রাতের শেষ আছে। ২৫ শে মার্চের কালরাত্রিও এক সময় পোহাল। দূরাগত আজানের ধ্বনি ভেসে আসল। না- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ থেকে সেদিন আজানের ধ্বনি উচ্চরিত হয়নি সাহস পাননি নামাজের আহ্বান জানাতে ধর্মপ্রাণ মুয়াজ্জিন। যেন মনে হল দূরাগত ঐ আজানের ধ্বনি মধ্যে সারা বাংলাদেশের কান্না ঝরে পড়ছে। এমন বিষদ আর ক্রন্দনময় আজান ধ্বনি জীবনে শুনিনি।

 রাত পোহাল, সকাল হল, ২৬শে মার্চের সকাল। সূর্যদেব কি সেদিন আমাদের সাথেও কেঁদেছিল, না রোষে গর্জন করে ছড়িয়েছিল দাবাগ্নি! পর্দা সরিয়ে দেখলাম আমাদের এলাকায় বেশ কিছু সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের উপস্থিত। দেখলাম মাঠের এককোণে জড় করা কয়েকটি মৃতদেহ, চোখের সামনে টেনে নিতে দেখলাম পাশের