পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২১

স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যই তা করেছিলেন। তাঁদের বেশীর ভাগের সামনেই দেশে তেমন কোন বিপদ ছিল না। বিমান বাহিনীর যারা ভারতে গিয়েছিলেন একাত্তরে তাদের সামনে অন্যান্য পথ খোলা ছিল। তাদের ভারতে যাবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, তাহলো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা।

 আগরতালা পৌঁছেই আমি মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শওকত আলী প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরদিন জেনারেল কালকাত সিং এবং আমি মেজর শাফায়েত জামিলসহ কোলকাতায় যাই। ওখানে পৌঁছে আমি কর্নেল ওসমানীর (পরে জেনারেল) সঙ্গে সাক্ষৎ করি। কোলকাতায় তাঁর সঙ্গে দুই দিন থাকার পর তিনি আমাকে ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ-আলোচনার জন্য দিল্লী যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। আমি তখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর জনৈক পদস্থ কর্মকর্তার সাথে দিল্লী যাই। ইতিমধ্যে আমার সাথে যে সব অফিসার সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন তাঁরাও দিল্লী এসে পৌঁছান।

 দিল্লী থেকে কোলকাতা ফেরার পর কর্নেল ওসমানী আমাকে জানালেন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আমাকে সরকারের সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চীফ অব ষ্টাফ নিযুক্ত করেছেন। সংসদ সদস্য কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) রবকে রাজনৈতিক কারণে চীফ অব ষ্টাফ নিয়োগ করা হয়েছে। একজন এমপি হিসেবে কর্নেল রব আগরতলায় মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়েই বেশী ব্যস্ত থাকতেন। ফলে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর বেশীর ভাগ দায়িত্ব আমার ওপরই ন্যস্ত ছিল।

 মুক্তিযুদ্ধের সামরিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সমগ্র এলাকাকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমাণ্ডার নির্ধারণ করা হয়। হেড কোয়ার্টারের সাথে যোগযোগের ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব কোন শক্তিশালী মাধ্যম না থাকায় আমরা ভারতীয় সেক্টরগুলোর সহায়তায় যোগাযোগ রক্ষা করতাম। কমাণ্ডার ইন চীফ-এর তরফ থেকে সেক্টর কমাণ্ডারদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। পরে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে সেক্টর কমাণ্ডারই নির্ধারণ করতেন কোন দায়িত্ব তিনি কেমন করে সম্পন্ন করবেন। সমগ্র এলাকাকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করার ফলে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা অধিকতর সমন্বয় সাধনে সক্ষম হই।

 ডেপুটি চীফ অব ষ্টাফ হিসেবে ট্রেনিং ও অপারেশনের দায়িত্ব ছিল আমার। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য যে সব যুবক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করতো তাদের জন্য বর্ডার এলাকাতেই ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। এইসব যুব ক্যাম্প থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করা হত। এই রিক্রুটমেণ্টের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের ভুমিকাই ছিল অগ্রণী এবং মূলত তারাই নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ করতেন।

 আমি বিশ্বাস করতাম যে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে সকলের সমান অধিকার রয়েছে এবং এ ব্যাপারটিকে সকল প্রকার দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা প্রয়োজন। এ জন্যই দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেনীর মানুষের মধ্য থেকে আমি মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগের চেষ্টা করেছি।

 মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের ব্যাপারে পেশাদারী মনোভাবের প্রয়োজন ছিল। যুবকদের মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা, মনোবল, দৃঢ়তা ইত্যাদি গুণাবলী নিয়োগ লাভের মানদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নিয়োগের ক্ষেত্রে ভিন্নতর নীতি অনুসৃত হওয়ায় কিছু কিছু অনভিপ্রেত ফল পরিলক্ষিত হয়। আমি ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি জনমতের সদস্যদের সাথে বহুবার আলোচনায় মিলিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সকল প্রকার কোন্দলের ঊর্ধ্বে রেখে সবাইকে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছি। রিক্রুটমেণ্টের ব্যাপারে আমি সব সময় কর্নেল ওসমানীর সাথে আলোচনা করতাম এসব বিষয় নিয়ে।

 মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার বেশ কিছুদিন পরে মুজিব বাহিনী নামে একটা আলাদা সশস্ত্র গ্রুপ গঠনের কথা আমি জানতে পারি। কর্নেল ওসমানী আলাদা নাম ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই বাহিনী গঠনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। আর আমিও এ ব্যাপারে তার সাথে সম্পূর্ণ একমত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সকল শক্তি ও সম্পদ একই