পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৬

 ২৩শে মার্চ সারদা একাডেমিতে পাকিস্তানের পতাকা উঠানো হয়নি। এ খবর পেয়ে রাজশাহী গ্যারিসনের লোকজন এমনকি জেলা প্রশাসনের কেউ কেউ সারদা এসেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কর্মসূচির সঙ্গে সংগতি রেখে সারদায় কালো পতাকা উঠানো হয় এবং পাকিস্তানী পতাকা নিশ্চিহ্ন করা হয়। গ্যারিসনের ধারেকাছেই আমরা এতকিছু করে যাচ্ছি অথচ তখন আমাদের কোন ভয়ভীতি ছিল না।

 ২৬শে মার্চের সকালে খবর পেলাম যে ইয়াহিয়া খানের সামরিক অভিযানে রাজারবাগ পুলিশলাইন, পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের অনেক অংশ বিধ্বস্ত হয়েছে। হাজার হাজার পুলিশ ও ইপিআর লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে। এসব খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অস্ত্রাগারের তালা খুলে দেয়া হয়। সারদা একাডেমির পুলিশ পরিবারগুলো কোন দিকে সরে যেতে পারেনি। কেননা স্থানীয় লোকজন কাউকে সেই অঞ্চল ছেড়ে যেতে দিচ্ছিল না। সামরিক যানবাহন চলাচলের প্রতিবন্ধকতা আগে থেকে তৈরী করা হয়েছিল। সরকারী আদেশে পদ্মায় নৌকা চলাচল বন্ধ। কাজেই সারদায় বসেই প্রতিরক্ষা/প্রতিরোধের জন্য তৈরী হওয়াই ছিল আমাদের একমাত্র উপায় ও লক্ষ্য।

 ৩১শে মার্চের শেষ রাতে খবর পেলাম যে একাডেমির পাশ দিয়ে রাতের অন্ধকারে কিছুসংখ্যক সৈন্য চলাচল করেছে। মিনিটকাল বিলম্ব না করে পরিবারসহ সেই অন্ধকারে আমার নিজস্ব গাড়ীতে করে একাডেমির বাইরে চলে আসি। সঙ্গে ব্যবহারের জন্য কাপড়-চোপড় ও টাকা-পয়সা কিছুই নিয়ে আসার সময় পাইনি। একডেমিতে এই নির্দেশ রেখে আসি যে এবার যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ নিরাপত্তার পথ বেছে নিতে বিলম্ব না করে। বেলা উঠার সঙ্গে সঙ্গে পুটিয়া থানায় এসেও সেনাবাহিনীর গতিবিধির খবর পেলাম। থানার প্রাঙ্গণে আমার গাড়ীটি ফেলে টমটম নিয়ে নওগাঁ-এর দিকে এগুতে থাকি। আমার স্ত্রী (সেলিনা), মেয়ে (সামিনা) এবং ছেলে (ইনান) আর বাবুর্চি রহিমুদ্দিনকে টমটমে দেখে কে বা কাহারা গুজব রটিয়ে দেয় যে, সারদার একজন পাঞ্জাবী অফিসার পালিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার প্রক্কালে একটি স্কুলের পাশে উপস্থিত হই এবং স্থানীয় একজন প্রিন্সিপালের বাসায় উঠি। সেখানে হাজার হাজার লোক এসে উপস্থিত। তারা বিশ্বাস করতে চায় না যে আমি বাঙ্গলী। প্রিন্সিপাল আমাদেরকে স্কুলের প্রাঙ্গণে নিয়ে আসেন। এমন সময় পার্লামেণ্ট সদস্য সরদার আমজাদ হোসেন সেই পথে যাচ্ছিলেন। আমাদের বিপদের কথা শুনে তিনি লোকজনকে বুঝালেন যে আমি বাঙ্গালী। কিন্তু কিছুসংখ্যক লোক দাবী করে যে, আমাকে বাংল ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে আমি বাঙ্গালী। আমজাদ হোসেনের পরামর্শে অগত্যা বক্তৃতা দিয়ে রেহাই পেলাম। কিন্তু সেখানে রাত কাটাতে সাহস হলো না। অন্ধকারে গরুর গাড়ীতে নওগাঁ-এর দিকে এগুতে শুরু করি। রাত এগারোটায় পথিমধ্যে বাগমারা থানাঘরে উঠে দেখি সেখানে কেউ নেই। কিছুক্ষণ পর একজন সিপাহীর দেখা পেলাম। ওসি বা অন্যান্য পুলিশ কোথায় সে জানে না। ওসির পরিবারের কাছে পরিচয় দিয়ে বৈঠকখানায় বসি। গভীর রাতে তিনি আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সিপাহীটি খবর দিল যে, ঐ জায়গায় আমাদের থাকা নিরাপদ হবে না। সিপাহী বহু কষ্টে একটি গরুর গাড়ীর বন্দোবস্ত করে দেন এবং আমরা ঐ রাতেই নওগাঁর দিকে এগিয়ে চলি। ভোর হতে না হতেই দা, লাঠি, বল্লম ইত্যাদি হাতিয়ার সজ্জিত হাজার হাজার লোকের বেড়াজাল ভেদ করে চলতে হয়। বেলা নয়টার দিকে একটি বাজারে এসে পৌঁছি। সেখানেও আমাকে পাঞ্জাবী বলে সন্দেহ করা হয় এবং আমার বাঙ্গালিত্বের পারিচয় দিতে হয়। পরিবারসহ নওগাঁয় আমাদের আত্মীয় পুলিশ ইন্সপেক্টর লোদীর বাসায় যাচ্ছিলাম। লোদীকে ডেকে আনার জন্য তিনি লোক পাঠালেন এবং আমাদের জন্য খাবার বন্দোবস্ত করলেন। ঘণ্টা চারেক পর লোদী সাহেব এসে আমাদেরকে নওগাঁয় নিয়ে গেলেন। কোত্থেকে কিভাবে এখানে এসেছি এ খবর শুনে লোদী পরিবার মর্মাহত। কিন্তু আমরা এতদিন পর নিরাপত্তা বোধ ফিরে পেলাম।

 এই সময় সান্তাহারে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালীদের মধ্যে হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার কাজে লোদী ব্যতিব্যস্ত। ম্যাজিস্ট্রেট আজিজুর রহমান ও মেজর নাজমুল হক মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। রাজশাহী জেলার জন্য প্ল্যান বানানো হলো। আমি সারদা অঞ্চলের ভার নেই। সঙ্গে থাকেন সারদা ক্যাডেট কলেজের ক্যাপ্টেন রশীদ এবং