পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৮

বাড়ীতে আশ্রয় নেই। সেই বাড়ীতে কয়েকশত লোক ইতিমধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। ডাক্তার আমাদেরকে যথাসম্ভব যত্নসহকারে রাখেন। পরের দিন ব্লক ডেভেলপমেণ্ট অফিসার আমাকে বহরমপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। আমার পরিবারের পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাকে জানাই। তিনি আমার বালুরঘাট যাবার ব্যবস্থা করেন। সেখানে নাটোরের এসডিও কামালউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। কয়েকদিন আগে তিনি এখানে পালিয়ে আসেন।

 বহরমপুরে সারদা একাডেমির পুলিশ ইন্সপেক্টর ক্ষিতিশের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়। তাকে সঙ্গে করে বালুরঘাট নিয়ে যাই। বহরমপুরে মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি। বালুরঘাট বাস টার্মিনালে কংগ্রেস কর্মী উৎপল আমাকে খুঁজে বের করে এবং তাদের বাসায় নিয়ে যায়। জানতে পেলাম বহরমপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমার খবর বালুরঘাট পাঠিয়েছেন। উৎপলদের পরিবার দেশ বিভাগের পূর্বে ঢাকা শহরের বাসিন্দা ছিল। উৎপলদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরের দিন ভোরে ক্ষিতিশ ও আরো কয়েকজনকে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত করে আমার পরিবারের তল্লাশে সীমান্তের এপারে পাঠানো হয়। প্রত্যেক দলের সঙ্গে আমার হাতের লেখা একটি চিঠি আমার পরিবারের জন্য দেই। নওগাঁয়ে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে সেখানকার লোকজন ভারত সীমান্তের দিকে পালিয়ে যায় এবং বিভিন্ন বাড়ীতে আশ্রয় নেয়—এই খবর বালুরঘাটে পৌঁছে। বর্ডারের মাইল পাঁচেক ভিতরে ধামুইরহাট থানা অঞ্চলে এক হাজী বাড়ীতে অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সঙ্গে লোদী পরিবার ও আমার পরিবার সেই বাড়ীতে পৌঁছে। কিন্তু তারা নিরুপায়। সীমান্তের অপর পারেই বা কোথায় যাবে। এদিকে আমার কোন খোঁজ-খবর তাদের জানা নেই। ক্ষিতিশ কয়েকটি আশ্রয়স্থল খুঁজে হাজী বাড়ীতে গিয়ে তাদের সন্ধান পায়। অতঃপর আমার পরিবার জীবনের চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার পথ বেছে নিয়ে ক্ষিতিশের সঙ্গে উৎপলদের বাড়ীতে এসে পৌঁছে। এখানেই আমার পরিবার জীবনের আরেক অধ্যায়ের সূচনা। উৎপলের বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই আমাদেরকে আপন বলে গ্রহণ করে। পশ্চিম দিনাজপুরের পুলিশ সুপার ঢাকা জেলার দোহার-নবাবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। আমার শ্বশুরালয়ের এলাকায় খৃষ্টান পরিবারের এই অফিসার ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের সদস্য। তিনি অভাবনীয় সৌজন্য দেখিয়ে আমাদেরকে একটি জীপে কলকাতা পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। এবং পথে আমাদের সকলের খরচ বাবদ একশত টাকা হাতে তুলে দেন।

 ১৮ই এপ্রিল সন্ধ্যার প্রাক্কালে কলকাতায় কীড স্ট্রীটের এমপি হোষ্টেলে বালুরঘাটের কংগ্রেস দলীয় এমপি জয়নাল আবেদিনের অতিথি হিসেবে আশ্রয় নিই। খাওয়া-দাওয়ার খরচ আমাদের নিজেদেরকে বহন করতে হয়েছিল। আমার বা আমার স্ত্রীর সঙ্গে কোন টাকা-পয়সা ছিল না। সামান্য গহনা ছিল মাত্র। আমাদের ছোট ছেলে ইনান তার জন্মদিনে পাওয়া চারশত টাকা সঙ্গে নিয়ে সারদা থেকেই বেরিয়েছিল। পালাবার দিন রাতে ঐ টাকা তার সঙ্গে ছিল। এখন তার টাকা খরচ করতে চায় না। তার হিসেব হলো এতজন লোক মিলে এই টাকা খেয়ে শেষ করার পর আমাদের অবস্থা কি হবে। এমপি হোষ্টেলের কোণে পান-বিড়ি দোকানের বেচাকেনা দেখে সে নিজে একটি পান বিড়ির দোকান করতে চায়। তার হিসেব অনুযায়ী দৈনিক ৭/৮ টাকা লাভ হবে এবং তাতে আমাদের খাওয়ার খরচ কোনক্রমে হয়ে যাবে। ঐ সময় আমাদের পাঁচজনের (বাবুর্চিসহ) জন্য দৈনিক ৫/৬টাকার বেশী খাওয়া খরচ করতে পারিনি।

 কীড ষ্ট্রীটে ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়ার আমবাগানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ পাঠের কথা শুনতে পাই। সোহরাব হোসেন, মমিনউদ্দিন প্রমূখ কয়েকজন কলকাতায় এমপি হোষ্টেলেই ছিলেন। কামরুজ্জামানের সঙ্গে দু’মিনিটের জন্য দেখা হলো। আমাদের বড় বড় নেতারা কে কোথায় আছে জানতে চাইলে তিনি কানে কানে বললেন যে, আগামী দিন সে খবর আমাকে দেয়া হবে। সে মুহূর্তে আমাদের নেতাদের অবস্থান সম্বন্ধে কেউ কিছু বলতে চায়নি।

 পরদিন হাইকমিশনে গিয়ে ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী ও পদস্থ অফিসার রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। রফিকের ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী তখন ঢাকায়। তাদের জন্য দুশ্চিন্তায় এবং কিছু পেশাগত