পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩০

সম্মুখীন হয়। দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত লোকদের মধ্যে অগণিত মুক্তিবাহিনী মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রতিরোধ ও আক্রমনে পাকবাহিনী কোথাও দাঁড়াতে পারেনি বলে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালাতে বাধ্য হয়। পলায়নরত পাক-বাহিনীকে ধাওয়া করেছে বাঙ্গালী কৃষক, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র, শিক্ষক সাবাই মিলে। এই দৃশ্য সবাই দেখেছে। প্রচার মাধ্যমের অভাবে তা অধিকাংশ সময় প্রচার করা সম্ভবপর হয়নি।

 ২৫শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের মানুষ নিরাপত্তা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু যাবে কোথায়? যারা সামরিক সরকারের চিহ্নিত শত্রু তাদের বেঁচে থাকার কোন সম্ভবনা ছিল না। এই সাধারণ বিষয়টি অনেকে চিন্তা করতে পারেনি। বাংলাদেশের লোকালয়ে আমার পক্ষে পালিয়ে থাকা সম্ভবপর ছিল না বলেই সারদার এত সব কর্মকাণ্ডের পর আমি দেশত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই। ভারতীয় ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ মানুষ হতাশা ও দুর্দশার বোঝা নিয়ে প্রতিদিন এসেছে। তাদের মধ্যে প্রথম দিকে অমুসলমান বাঙ্গালীর সংখ্যাই ছিল বেশী। কিন্তু পরবর্তীকালে পরিস্থিতি হয়েছে ভিন্নতর। ক্যাম্পে সকলেই মিলে দিন কাটিয়েছে। ধর্মীয় ভেদাভেদ আমাদের নজরে পড়েনি।

 পাকিস্তানের বর্বর অভিযানের মোকাবেলা করার মত অস্ত্রবল আমাদের ছিল না। এপ্রিল-মে-জুন মাসগুলোয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতীয় মনোভাব আশাব্যঞ্জক ছিল না। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য আমাদেরকে সমরিক সাহায্য দেবে এ কথা আমরা ভাবতে পারিনি। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মনোভাব যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে—যদিও এটা ছিল স্বাভাবিক কিন্তু আমাদের কাছে সেটি ছিল বেদনাদায়ক ও হতাশাব্যঞ্জক। প্রায় এক কোটি বাঙ্গালী ভারতে যেভাবে আশ্রয় নিয়েছিল তাতে ভারতবাসীরা শংকিত হয়ে ওঠে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বেগজনক সমস্যা সৃষ্টি করেছিলাম বৈকি। ঐ দুর্দিনে আমরা ছিলাম নক্সালপন্থীদের ভয়ে ভীত। চলাফেরায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় ছিল না। বিশেষ করে আমাদের নেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা খুব বিব্রত ছিলাম। সে জন্য তাঁদের আবাস্থলে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। সিআইটি রোডের একটি তৃতীয় শ্রেণীর হোটেলে এক রুমে আমাদের মন্ত্রী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে পরিবারসহ বসবাস করতে হয়েছে। এই হোটেলকে নিয়েই আমাদের শত্রুরা অপপ্রচারের ডামাডোল বাজিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের দু’চারজন আত্মীয়-স্বজন ছিলেন। তাঁদের কাছে আশ্রয় চেয়ে হতাশ হয়েছি। তারা বড়জোর একদিন দু’দিন থাকতে দেবার পর অন্যত্র চলে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা মনেপ্রাণে চাননি যে পাকিস্তান দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে যাক। হাইকমিশনের পদস্থ কর্মচারী রফিকুল ইসলাম চৌধুরী আমাদেরকে তাঁর বাসায় রাখেন। তাঁর বাসায় আরো তিরিশজন লোক ছিলেন। এতজনকে প্রায় তিন মাস খাইয়ে-দাইয়ে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবু তিনি ও তার স্ত্রী আমাদেরকে বাড়ী ছাড়তে দিবেন না। বহু বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে রাজী করেছি। অতঃপর গোবরা করবখানার নিকটবর্তী একটি বাড়ীতে বসবাসের ব্যবস্থা করি।

 এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে মেঘালয়, মিজোরাম এবং আসামের কোন কোন অঞ্চলে আমাদের লোকজন যখনই প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছে। তখনই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, এমনকি স্থানবিশেষে বন্দী জীবন কাটিয়েছে। তাদেরকে উদ্ধার করার কাজে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিছুসংখ্যক লোককে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও উদ্ধার করতে হয়েছে। কংগ্রেসবিরোধী ভারতীয় রাজনৈতিক মহল আমাদের সহায়তায় খুব বেশী আগ্রহ দেখায়নি। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৪৭ সালের পর থেকে বহু পূর্ববঙ্গবাসী বসবাস করছে বলে সেখানে স্ববাবতঃ আমরা এককালীন প্রতিবেশীসুলভ ব্যবহার পেয়েছি।

 পাকিস্তান সরকার রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ইত্যাদি বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে যে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল তার কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমরা ভারত থেকে গ্রহণ করতে পারিনি। এই বাহিনীগুলোর সহায়তায় গণহত্যা, নারী নির্যাতন অভিযান চালানো হয়েছে। এই বর্বরতার খবরাখবর আমাদেরকে মরিয়া হয়ে ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের মত যারা দেশের বাইরে যেতে পারেননি তারাই সবচেয়ে বেশী ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছেন-এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। যুদ্ধের সেই ভয়াল মাসগুলোয় অহরহ খবর পেয়েছি যে যশোর, নোয়াখালী, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আরো