পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩৬

আব্দুল মালেক উকিল

 ১৯৭১ সালে আমি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের (লক্ষীপুর ও ফেনী জেলাসহ) সভাপতি ছিলাম। একজন এম,এন, এ হিসেবে আমিই ‘৭১ সালে জিলা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হই। ইতিপূর্বে আমি ১৯৫৬, ৬২ এবং ৬৫ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, আওয়ামী লীগ পার্লামেণ্টোরী পার্টি ও সম্মিলিত বিরোধী দলের নেতা হিসেবে কাজ করেছি। নিখিল পাকিস্তান বার কউন্সিলএর নির্বাহী কমিটির নির্বচিত সদস্য হিসেবে ও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির পার্লমেণ্টারী বোর্ডের সদস্য হিসেবে ১৯৬৬ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী লাহোরের গুলবাগে নিখিল পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে আমি সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতিত্ব করি এবং ঐ অধিবেশনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন। ঐ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন, অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ আমরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ছয়জন প্রতিনিধি ছিলাম। তার পরের ইতিহাস খুবই করুণ হলেও বাঙ্গালী জাতির মুক্তিসনদ হিসেবে শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের জি, এম সৈয়দ হারিনেতা কাজী ফয়জুল্লাহ, সীমান্ত ও বেলুচিস্তান প্রদেশের আরবাব সেকান্দর হায়াত খান, মানকি শরিফের পীর আতাউল্লাহ খান মঙ্গল, গাউস বক্স বেজেঞ্জো, রেয়াছানী, শেখ মঞ্জুরুল হক, খলিল তিরমিজিসহ সকলেই প্রকাশ্যে ছয় দফা সমর্থন দিয়েছিলেন।

 ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকেই আমরা একই সাথে ঢাকায় দিনের পর দিন আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠক ও ৬ দফার ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র রচনার কার্যে নিয়োজিত ছিলাম। ১৫ই মার্চ ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে আসার পূর্ব পর্যন্ত, বিশেষ করে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের জরুরী অধিবেশন কখনও কখনও সারা রাত্রি ধরে চলতো। পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এবং সংলাপের সময় আমরা দৈনন্দিন অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের মতামত ব্যক্ত করতাম। কিন্তু ২৪শে মার্চ বঙ্গবন্ধু হঠাৎ আমাদেরকে অবিলম্বে ঢাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দেন এবং তদনুযায়ী আমি ২৪শে মার্চ নোয়াখালীতে (মাইজদী) চলে যাই। স্মরণ করা যেতে পারে, ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার ও ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাজেই আমাদের নিজ নিজ এলাকায় চলে যেতে এবং নির্দেশের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে কোন অসুবিধা হয়নি। ২৫ মার্চ রাত ১১টা আমার মাইজদীস্থ বাসভবনে আমার নিজস্ব টেলিফোনে আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর ৩২নম্বর বাড়ীর বিখ্যাত ৪২৫১ টেলিফোনে যোগযোগ করি। একবার ঐ বাড়ীতে অবস্থানরত হাজী গোলাম মোর্শেদ (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী) টেলিফোনে আমার সাথে কথা বলেন এবং তিনিও সতর্ক করে দেন যে, “যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে“। বঙ্গবন্ধু শুধু চীৎকার করে বলেছিলেন, “এখনও বসে আছ? সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে”।

 ২৬শে মার্চ সকালেও আমরা বিভিন্ন সূত্রে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা এবং হানাদার বাহিনীর গণহত্যার কথা অবহিত হই। এ সময় নোয়াখালী জেলার ডেপুটি কমিশনার ছিলেন জনাব মনযুর উল করীম (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব)। আমি তাঁর মারফতে জেলা ও দায়রা জজ গাজী শামসুর রহমান (বর্তমানে প্রেস কাউন্সিলের সভাপতি) এবং পুলিশ সুপার শহীদ আব্দুল হাকিমসহ মহকুমা প্রশাসক ও সকল সরকারী কর্মচারী, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারকে নোয়াখালী সার্কিট হাউসে ২৬ তারিখে ১০টার মধ্যে সমবেত হওয়ার জন্য আহবান জানাই। আওয়ামী লীগের সমস্ত এমপি এ, এম এন এ ও বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও ঐ সমাবেশে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করি। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সমস্ত সার্কিট হাউজ এবং সম্মুখের ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। উক্ত সমাবেশে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসেবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম করার জন্য দলমত ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে আহ্বান জানাই। উপস্থিত সর্বস্তরের জনগণ এবং জিলা ও দায়রা জজসহ সকল স্তরের কর্মচারী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বাধীন বাংলার