পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৪০

সালাউদ্দিন এবং গোলাম মোস্তফাকে নামিয়ে দেই। স্কর্ট পার্টি হিসেবে মিঃ খানের জীপ ৩/৪ জন পুলিশ বর্ডার পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিল। যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিশ্বস্ত ড্রাইভার মাহমূদ বাবা-মা ছেড়ে আমার সঙ্গে ছিল। ২৬ এপ্রিল তারিখে নোয়াখালীর পতন হয়। সমগ্র শহর হানাদার বাহিনী দখল করে নেয়। আগরতলায় এসে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ও বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এবং অন্যান্যের সঙ্গে বিশেষ করে ২নং সেক্টরের মেজর খালেদ মোশারফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রেরণের ব্যবস্থা করি।

 ইতিমধ্যে মুজিবনগর থেকে জরুরী ভিত্তিতে কলকাতা গমনের জন্য আমার ডাক আসে। আমি পূর্বেই সব কিছু জহুর আহমদ চৌধুরীকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাই। ৯নং সার্কাস এভিনিউ অর্থাৎ “বাংলাদেশ মিশনে দেশী বিদেশী অনেক ব্যক্তি, বিশেষ করে পিটার হেজেল হার্স্ট, New York Times & Christian scicnce Monitor এর প্রতিনিধি IIcnry Haward Ges Mark Gayan এর সঙ্গে আমি বাংলাদেশের গণহত্যা এবং প্রাসংগিক বিষয়ে আলোচনা করি। এখানে প্রয়াত ডঃ মুজাফফর আহমদও উপস্থিত ছিলেন। কখনও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদও উপস্থিত থাকতেন।

 ইতিমধ্যে খবর পেলাম আমার গ্রামের বাড়ী (রাজাপুর), শ্বশুরবাড়ী (আবদুল্লাহপুর) এবং দুই বোনের বাড়ী (যথাক্রমে করিমপুর ও বারইপুর) হানাদাররা আক্রমণ করেছে। আমার মাইজদীর পাকা দ্বিতল বাড়ী অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার শ্বশুরবাড়ীতে সৌভাগ্যবশতঃ আমার স্ত্রী ও বড় দুই মেয়ে সেদিন উপস্থিত ছিল না। ঐ দিনই সন্ধ্যায় রাতে তারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলো। ছোট দুই মেয়ে লিলি ও মায়া (১০বৎসর, ৭ বৎসর) সহ বাড়ীর সমস্ত স্ত্রী-পূরুষকে বন্দী করে বাহির বাড়ীতে উঠিয়ে নেয় এবং সমস্ত পুরুষকে ট্রাকে করে মাইজদী ক্যাম্পে নিয়ে আসে। দীর্ঘ ৪ মাস কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রেখে তাদের উপর নির্যাতন করে, এবং গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দেয়। ৪জনকে গুলি করে হত্যা করে। পরে অবশ্য তারা বাড়ীর সমস্ত মহিলা ও শিশুকে এক বেলুচ ক্যাপ্টেনের নির্দেশে ছেড়ে দেয়। ভাগ্যক্রমে আমার বড় ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন (লাতু) পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে কচুরীপানার নীচে দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। হানাদাররা দুই বোনের সমস্ত ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়। ছোট বোনটির মৃত্যু এর পূর্বেই হয়েছিল এবং তার স্বামীও জীবিত ছিল না। একমাত্র ভগ্নে মফিজ তখন সামরিক বিভাগের চাকুরীতে পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটে আটক। ভাগ্নী জামাই মমিন উল্লাহ এবং তার বড় ভাইয়ের কলেজে পড়ুয়া দুই ছেলে নূরউদ্দিন, শাহাবুদ্দিনসহ নয়জনকে লাইনে দাড় করিয়ে হানাদার বাহিনী ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলী করে হত্যা করে। এই মর্মান্তিক খবর আমাকে জানানো হয়নি। যেমন জহুর আহমদ চৌধুরীর জ্যৈষ্ঠ ছেলের মৃত্যু সংবাদও তাঁর নিকট গোপন রাখা হয়েছিলো। আ স ম আব্দুর রব ও অন্যান্যের চেষ্টায় আমার স্ত্রী, কন্যা ও মৃত ভগ্নীর ছেলে মঞ্জু এবং আমার ছোট ভাই এনায়েত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বেলোনিয়ায় পৌঁছে। এ সময় মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় তীব্রভাবে সাম্প্রদায়িক দাংগা দেখা দেয়। স্মর্তব্য, কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ এবং আলীগড়সহ ভারতের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মুসলমান যুদ্ধের প্রথম দিকে তীব্রভাবে মুক্তিযোদ্ধের বিরোধিতা করে। তাদের ধারণা ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তাদের ভ্রমাত্মক ধারণা দূর করার জন্য মুজিব নগর সরকার বিশেষ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর আলী আমাকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত হিসেবে নদিয়া, কৃষ্ণনগর, বহরমপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠান। এ সময় ফরিদপুর থেকে লক্ষাধিক তপশীলী সম্প্রদায়ের লোক উপরোক্ত এলাকাগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। যতদুর মনে পড়ে বহরমপুর সীমান্তে একদিনেই প্রায় ১০ হাজার নমশূদ্র ঢাল সড়কি নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আল্লাহর রহমতে আমি, মরহুম গোলাম কিবরিয়া এম এন এ, আজিজুর রহমান আক্কাছ এম এন এ ও অন্যান্য এমপি এবং বহরমপুরের তরুণ আই এ এস অফিসার মিঃ ডি কে ঘোষ-এর সহযোগিতায় প্রত্যেক মুসলমানের বহিঃ বাড়ীর ঘর, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সমস্তই বাস্তুহারাদের আশ্রয়ের জন্য ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে সফলকাম হই। এমনকি সরকারী নির্দেশে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মারওয়ারীদের বিরাট বিরাট পাটের খালি গুদাম বাস্তুহারাদের জন্য খালি করে দেয়া হয়। মিসেস সুভদ্রা এম,পি ও তদানীন্তন কংগ্রেসের মহাসচিব হেনরি অস্টিনসহ আমরা