পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৫৯

ওপর বসে আমরা দু’জন পাকসৈন্যদের হামলার মুখে ভয়ার্ত মানুষের আর্তচিৎকার শুনছি। এক সময় তীব্র নীলাভ এক উজ্জ্বল আলোতে ঢাকা শহর আলোকিত হয়ে উঠল। বিভিন্ন স্থানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের কালো ধোঁয়ায় ঢাকার আকাশ ক্রমশঃই কালো হয়ে উঠছে।

 মধ্যরাতের দিকে ব্রাশ ফায়ার ও বিকট শব্দ শুনে তাজউদ্দিন আহমদ বলে ওঠেন, এবার দস্যুরা ৩২ নাম্বার বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে হামলা করছে। এ সময় তিনি কেঁদে উঠলেন। বঙ্গবন্ধু কি তাঁর বাসা থেকে বেরিয়েছেন? বঙ্গবন্ধু যখন কোন আবস্থাতেই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে অসম্মত হন, তখন আমাদের সর্বশেষ অনুরোধ ছিল, তাঁর বাড়ীর পেছনে জাপানীদের অফিসে যেন তিনি চলে যান। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কথা, তার পরিবার পরিজনের কথা, দলের বিভিন্ন নেতাদের কথা বার বার মনে হতে লাগলো।

 এক সময় আমরা দুইজন ছাদ থেকে নেমে এলাম। নীচে এসে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। শুধু ভাবছি আর ভাবছি। এমনিভাবে রাত ভোর হতে চলল। চারদিক থেকে গুলির শব্দ আসছে। শরীর ও মন অবসন্ন হয়ে উঠছে।

 সকালে আমি বাথরুমে গেলাম। আয়নায় নিজের চেহারা দেখলাম। মনে হলো এক রাতে একটা শতাব্দী পার হয়ে গেছে।

 পাশে পড়ে ছিল গফুর সাহেবের ব্লেড। ১৯৬১ সালে লণ্ডনে ব্যারিষ্টারী পড়ার সময় সযত্নে রক্ষিত ফ্রেঞ্চ দাড়ি কেটে নিলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর তাজউদ্দিন ভাই অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকালেন। বুঝলাম, দাড়ি কাটা কাজ দেবে। ২৬ শে মার্চ সকালে দু’জন বসে গত রাত থেকে ঘটনাগুলো বুঝবার চেষ্টা করলাম। নিজেদের কর্তব্য স্থির করতে দেরী করিনি। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রথম কাজ হলো এই বাড়ী ত্যাগ করা। বাড়ীর সামনে দিয়ে পাক বাহিনীর টহলদার জীপ আসা-যাওয়া করছে রুমাল বেঁধে জীপে করে পাক সেনাদের সাথে ঘুরছে। তারা বঙ্গালী নেতা-কর্মীদের বাড়ীঘর, অবস্থান পাক বাহিনীকে দেখিয়ে দেয়ার কাজে সহযোগিতা করছে আন্দাজ করলাম।

 স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির একটি চালাঘরে কয়েকজন কর্মী আত্মগোপন করে রয়েছে। তাদের কাছে একটা রেডিও ছিল। ওরা রেডিওর খবরাখবর শুনছে।

 ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া বক্তৃতা দেন। আমরা দেয়ালে কান পেতে বেতারে ইয়াহিয়ার বক্তৃতা শুনি। পাক প্রেসিডেণ্ট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিষোদ্গার করেন। জনগণকে শতকরা ৯৭ ভাগ ভোট লাভকারী আওয়ামী লীগকে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান বেআইনী ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়ার গলা থেকে সুতীব্র ক্রোধ বেরিয়ে আসে। ইয়াহিয়ার বক্তৃতা ও গত কয়েক ঘণ্টার নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমরা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি।

 দু’জনে ঠিক করলাম, পাক বাহিনীর এই বর্বরোচিত হামলার খবর যে কোনভাবে বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে। ২৫শে মার্চে ঢাকায় গণহত্যার খবর ভারত বা বিশ্বের কোন বেতারে প্রচার হয়নি। তবে ২৬শে মার্চ রাতে অস্ট্রেলিয়া বেতার ঢাকার গণহত্যার খবর প্রচার করে।

 পাক বাহিনী আমাদের বাড়ী সার্চ করতে পারে এই আশংকায় আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ি। প্রথম সমস্যা তাজউদ্দিন আহমেদের রাইফেল। যদ্দিন আমরা এই বাড়ীতে ছিলাম, এর সমাধান করতে পারিনি। দ্বিতীয় সমস্যা, আমাদের তিনজন পুরুষ মানুষ ছাড়া এ বাড়ীতে কোন মেয়ে মানুষ নেই। মেয়ে লোক না থাকাতে আমাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে।