পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৬৪

 পদ্মার ঘাটে ছোট বড় অনেক নৌকা। অনেক নৌকা খুলনা বরিশালে ধান কাটতে যাচ্ছে। আমরা ভাবছি এবারে ফসল কেটে সব নৌকা কি ঘরে ফিরতে সমর্থ হবে? এমনিভাবে ভাবতে ভাবতেই নদী পার হওয়ার জন্য নৌকায় উঠছি। সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলছি। সকলের মনেই ভীতির ভাব। এমন সময় আইডব্লিউটিএ’র একটি মোটর যান দেখা গেল শব্দ করে আমাদের দিকে আসছে। কেউ কেউ এটাকে পাক সামরিক বাহিনীর মোটর যান ভেবে আশংকা প্রকাশ করে। আমি বললাম, এত তাড়াতাড়ি ওরা ঢাকা ছেড়ে আসতে পারে না। মোটর যানটি কছে আসার পর দেখা গেল এতে কিছু সাধারণ যাত্রী রয়েছে। পরে শুনেছি, পাক বাহিনী যাতে ব্যবহার না করতে পারে এ জন্য শ্রমিকরা এই বোটগুলোকে নিয়ে এসেছিল।

 আমরা নদীর ওপারের খবর জানি না। সেখানে একটি বাজার দেখা যাচ্ছে। একটি নৌকা করে আমরা নদীর ওপারে যাই। আর নদীর এপার থেকেই পথ দেখাতে আসা স্কুলের পিওনকে বিদায় করে দেই।

 বাজারের পাশেই একটি মাঠ। মাঠে কেউ লাঙ্গল চালাচ্ছে কেউ বা অন্যান্য কাজ করছে। চারদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হলো। এই অবস্থায় আমরা বাজারে গিয়ে পৌঁছি। বাজারে গিয়েই সেখানাকার সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের সাথে দেখা হলো।

 আমরা এখান থেকে ফরিদপুর যাব। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ছাড়া অন্য কোন পথে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি পায়ে হাঁটা পথও ভাল নয়। খাল, বিল, নালা পেরিয়ে যেতে হবে। তবে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া যায়। অগত্যা আমরা দুটি ঘোড়াই ভাড়া নেই। এই বাজার থেকে ৭ মাইল দূরে ফরিদপুর শহর। ঘোড়ায় চড়ে শহরের এক প্রান্তে নামি। সেখান থেকে রিক্সাযোগে আওয়ামী লীগ নেতা ও এম.পি ইমামউদ্দিনের বাড়িতে উপস্থিত হই। বাড়ীতে পা দিয়েই বুঝলাম লোকজন বেশ শংকিত। গত রাতে শহর থেকে লোকজন গ্রামে চলে গেছে। ঢাকা থেকে লোকজন এসে সেখানকার ভায়াবহ পরিস্থিতির কথা বর্ণনা দিয়েছে। ঢাকার মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের কথা শুনেই লোকজন রাতের বেলা শহর থেকে চলে যায়।

 ইমামউদ্দিনের স্ত্রী খুবই সাহসী মহিলা। বাড়ীতে তিনি একা। ইমামউদ্দিন বাড়ীতে নেই, তিনি সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীদের নিয়ে আশেপাশের পুলিশ ও বি ডি আর-এর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। স্ত্রীর কাছ থেকে খবর পেয়ে ইমাম সাহেব বাড়ী আসেন। তাড়াতাড়ি ডালভাত রান্না হলো। শহরের লোক আশংকা করছে এখানে যশোরের পাক সৈন্যরা যে কোন সময় হামলা করতে পারে।

 আমরা সবে মাত্র খেতে বসেছি। এমন সময় খবর এলো পাক সৈন্য এদিকে আসছে। কোন দিক দিয়ে আসছে সে সময় তা বুঝা গেল না। চারদিক লোকজন ছুটোছুটি করছে প্রাণ ভয়ে। মনে মনে ঠিক করলাম এখান থেকে মাগুরার পথে রওয়ানা হবো। সেখান থেকে যশোর সেনানিবাস ও আশেপাশের খবর পাওয়া যাবে।

 স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনা শেষে আমরা ফরিদপুর ত্যাগ করি। রাস্তার বিভিন্ন অংশ কেটে দেয়া হয়েছে পাক সৈন্যর গতি রোধ করার জন্য। একটা রিক্সাযোগে আমরা কামারখালীর পথে চলেছি। কোথাও কোথাও নিজেরা রিক্সা পার করেছি। এমন সময় ফরিদপুরের দিকে একটি জীপ আসতে দেখি। জীপটি কার তা দেখার জন্য আমরা রাস্তার আড়ালে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম জীপটিতে অসামরিক লোক রয়েছে। জীপে চালকের সাদা পোশাক পরিহিত একজন ভদ্রলোক বসা। রাস্তায় এসে জীপটি নামাবার ইঙ্গিত দেই। পরিচয় নিয়ে জানলাম তিনি রাজবাড়ীর মহকুমা প্রশাসক। নাম শাহ ফরিদ। তাঁর কাছে টুকরো টুকরো খবর পেলাম।

 শাহ ফরিদ মেহেরপুর গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি চুয়াডঙ্গার সাথে যোগযোগ করেছেন। তিনি জানান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তওফিক ইলাহী চুয়াডাঙ্গার পুলিশ ও বি ডি আর এর সাথে যোগাযোগ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ঝিনাদহ, যশোর, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়ার জনগণ পাক