পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

99 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড গোটা দুই-হাত কিংবা পায়ে বা অন্য কোথাও বেশ কিছু ছেলে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের কাছে তা বিশেষ কোন ব্যাপার নয়, জীবনে আর পাঁচটা ঘটনা প্রত্যেকদিন ঘটে, ঘটেছে; এও তেমনি। সে জন্যে এসব ব্যাপারে কোন মুক্তিসেনার ভ্রক্ষেপও নেই। তাদের সবার সামনে একটি মাত্র লক্ষ্য-শত্রু ধ্বংস করা। দুটি তরুণের কথা শুনলাম। কয়েকবার যুদ্ধ করেছে এমন একটি ছেলের নাম খোকন। স্কুলের ছাত্র। হালকা গড়ন। লাজুক লাজুক ভাব। সবার সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতো। যুদ্ধ করতে করতে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, কোন সুযোগ এলেই সে লাফিয়ে উঠতো। তার সঙ্গে শেষবারের মতো যখন আমার দেখা হয় তখন সে বারবার আমাকে বলেছিল, “আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য শুক্র খতম করে এদেশের শোষিত মানুষকে সত্যিকার স্বাধীনতা দেয়া। কেউ যেন আর কোন দিন আমাদের বঞ্চিত পদদলিত করতে না পারে সে জন্যই আমরা জীবন দিচ্ছি। পাক-সেনাদের দ্বিমুখী আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিল খোকন। একটি সজিনা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গুলি চালাচ্ছিল সে। তার শেষ চেষ্টা ছিল সঙ্গীদের বাঁচানো। কয়েকজন খানসেনাকে খতম করার পর একটি গুলি সজিনা গাছ ভেদে করে তার শরীর বিদ্ধ করে। মৃত্যুর শেষ মুহুর্তে তার উত্তর ছিল একজন খান সেনার উদ্দেশে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে দেয়া। তাতেই খানরা তাদের বহু সঙ্গীকে হারিয়ে পালিয়ে যায়। কাছাকাছি এক শিবিরে দেখা হয় হাবলুর সঙ্গে। তার বুকে পাশ থেকে এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে। বাঁ হাতেও লাগে কয়েকটি গুলি, বা পা-ও রেহাই পায়নি। ডান হাত ছাড়া হাবলুর কোন অঙ্গই আর চালু ছিল না। বুক পেটের সামনের মাংস সমেত উড়ে চলে যায়, হাত-পা আচল তবু হাবলু যুদ্ধ চালিয়ে গেছে এক হাতে, ছুড়েছে গ্রেনেড। যে খানসেনাটি তাকে গুলি করেছিল তাকে হাবলু শেষ করেছে এক গ্রেনেডেই। সামনে যে কয়টি পড়েছিল তাদের কাউকেই ছাড়েনি সে। তারপর বুকে হেঁটে জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সে নিরাপদ জায়গায় চলে। হাবলুর বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো অচল হয়ে গেছে। হাবলু বললো, “আমরা এখন খানদের একেবারে কাছে না পেলে আর গুলি ছুড়ি না। ওরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে, আমরা হিসেব করে গুলি খরচ করি। ওরা বেহিসাবীর মতো মরে, মরে অন্যায়ের ধ্বজাধারী হয়ে। আমরা মরি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, প্রতিটি প্রাণ আমাদের অমূল্য, একটি একটি মৃত্যু একটি অবদান।” এরকম বহু খোকন ও হাবলুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তারা সবাই প্রাণ দিচ্ছে, দেবে। তারা বারবার বলেছে, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা শোষণের শেষ ঘাঁটিটি পর্যন্ত ধ্বংস করতে চাই। কড়াই থেকে আগুনে পড়তে চাই না আমরা। দশ লক্ষ নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। মরছে প্রতিদিন হাজার হাজার। রক্ত দিচ্ছে মুক্তিসেনারা, দেশ সম্পূর্ণ শত্রমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এর বিরাম নেই। কিন্তু তার মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ যেন মুছে যায়, শোষক যেন ধ্বংস হয়। শোষক যেন না গজায়, গরম কড়াই থেকে আমরা যেন আগুনে না পড়ি। তাহলেই, কেবল তাহলেই আমাদের জীবন বিসর্জন, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের যুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ সার্থক হবে। ("জাফর সাদেক’ ছদ্মনামে মোহাম্মদ আবু জাফর রচিত) ৩ নভেম্বর, ১৯৭১ মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল প্রবাদটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য পিণ্ডি অধিকর্তাদের বেলায়। কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, ৯০ লক্ষ লোককে দেশত্যাগী, আরো অসংখ্য গৃহ ভস্মীভূত এবং লুণ্ঠন করে হঠাৎ টনক নড়েছে। আজ ইয়াহিয়ার বাদশাহী সিংহাসন টলোমলো, জল্লাদবাহিনীর আর্তনাদে মুখর সমস্ত পাকিস্তানের আকাশ বাতাস। যারা এসেছিল এদেশকে পদানত করতে, শৃংখল পরাতে, ধনসম্পদ লুট করতে আজ মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে হত্যাকারী হয়ে উঠেছে হতোদম, গতপ্রাণ। জল্লাদ বাহিনীর মনেও আজ ভয়, সন্ত্রাস দানা বেদে উঠেছে। মুক্তিবাহিনীর নাম শুনলে তিনবার ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করে।