পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

107 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড বয়ে চলেছে বাংলার দিকে দিকে। ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, বিধ্বস্ত জনপদের ধ্বংসস্তুপ সাক্ষী হয়ে আছে ওদের পাশবিক নির্যাতনের। হানাদার দসু্যরা নারীর কেড়ে নিচ্ছে, দুধের শিশুকে খুন করেছে, দলে দলে মানুষকে করছে ঘরছাড়া, দেশছাড়া। অধিকৃত এলাকার মানুষ নিজের চোখে দেখেছে, দেখছে এ দৃশ্য। কিন্তু ঢাকা বেতারে শুনছে ঠিক এর উল্টো কথা। ঢাকা বেতার সুকৌশলে প্রচারণার মারপ্যাচে সত্যটাকে হত্যা করে মিথ্যার পুতুল সাজিয়ে খাড়া করছে মানুষের কাছে। তাই তারা আস্থা হারিয়েছে- বীতশ্রদ্ধ, অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ঢাকা বেতারের উপর। আর সেই কারণেই কেউ আজ ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান শুনছে না। তারা সত্যি খবরের জন্য, নির্ভুল তথ্যের জন্য, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বজনমতের ধারা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য শুনছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি, আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকার অনুষ্ঠান। জঙ্গীশাহী এ খবর জানে। তারা জানে যে, এসব বেতার কেন্দ্রের মারফত জনগণ হানাদারদের নির্যাতন-নিপীড়ন-গণহত্যার লোমহর্ষক কাহিনী জেনে নিচ্ছে। জেনে নিচ্ছে বাংলাদেশের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় সাফল্য এবং হানাদারদের ক্রমাগত বিপর্যয়ের বৃত্তান্ত। ফলে ওদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ধরা পড়ে যাচ্ছে ওদের মিথ্যাবাজি আর জালিয়াতির বেসাতি। তাই শংকিত, বিব্রত হয়ে উঠেছে জঙ্গীশাহী। ওরা জানে, লোকের হাতে যদি রেডিও থাকে, ঢাকা বেতারের জাল-জুয়াচুরি অনুষ্ঠান তারা শুনবে না- শুনবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও বিদেশী বেতারের অনুষ্ঠান। তাই আক্রোশের ক্রোধে দিশেহারা হয়ে জল্লাদেরা এখন কেড়ে নিতে শুরু করেছে সকল রেডিও উদ্দেশ্য-মিথ্যে যদি না শুনতে চাও, সত্য কথাও শুনতে দেবো না...। ১আগষ্ট, ১৯৭১ পাকিস্তানের জঙ্গশাহী বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় উৎপাদিত ফসলের তিন-চতুর্থাংশ সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দোবর জন্য চাষীদের প্রতি নির্দেশ জারি করেছে। নির্দেশে বলা হয়েছে যে, ফসলের এক-চতুর্থাংশ নেওয়া হবে জরিমানা হিসাবে এবং বাকী দুই-চতুর্থাংশ নেওয়া হবে ট্যাক্স ও খাজনা বাবদ। বুঝতে এতটুকু কষ্ট হবার কথা নয় যে, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় চাষীদের শায়েস্তা করা ছাড়াও আরেকটা উদ্দেশ্য আছে এই নির্দেশে জারি করেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধ পশ্চিমা শাসকদের রাজকোষ শূন্য করে দিয়েছে। আর সেই শূন্য রাজভাণ্ডার পূর্ণ করে তোলার জন্যই জল্লাদ ইয়াহিয়া করেছে এই তোগলকি নির্দেশ। একথা আজ সকলেরই জানা যে, বাংলাদেশে যুদ্ধের বিপুল ব্যয়ভারের চাপে পাকিস্তানী অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে পাট, চা, চামড়া সহ সমস্ত রকম রফতানী বাণিজ্য বন্ধ। কলকারখানায় উৎপাদন নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে থাকার দরুন ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছে চূড়ান্ত অচলাবস্থা। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংরক্ষিত বাজারে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য বিক্রয়ের নামে হরিলুটের বাতাসের মত দুহাতে অর্থ লুটে নেবার দিন শেষ। রাজত্ব আদায় বন্ধ-বাংলার মানুষ খাজনা দিচ্ছে না, ট্যাক্স দিচ্ছে না। আয়ের কোটা শূন্য কিন্তু খরচ বেড়েছে বহুগুণ। প্রশাসনিক ব্যয় ছাড়াও জঙ্গশাহী বাংলাদেশে গণহত্যা খাতে প্রতিদিন খরচ করছে দেড় কোটি টাকা। এত টাকা আসবে কোথা থেকে? বৈদিশক সাহায্য বন্ধ। পৃথিবীর দেশে দেশে ভিক্ষার ঝুলি হাতে ঘুরেছে ইয়াহিয়ার অনুচরেরা, কিন্তু উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়নি। তাই রাজকোষ শূন্য-নিদারুণ অর্থসংকট, পরের ধনে পোদ্দারিতে ঘটেছে মারাত্মক বিঘ্ন। বেসামরিক কর্মচারীদের যুদ্ধ করা যায় না। আর এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্যই টাকা চাই-প্রচুর টাকার দরকার ইয়াহিয়া খানের। টাকার দরকার বাঙালী হত্যার হাতিয়ার কিনতে, জল্লাদ ভাড়া করতে। আর সে টাকা ওরা আদায় করতে চায় বাংলাদেশেরই চাষীদের কাছ থেকে। এই লক্ষ্য হাসিলের জন্যই জারি হয়েছে নরঘাতক ইয়াহিয়ার নয়া নির্দেশ।.