পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

228 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড দিবসের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে নব-জন্মগ্রহণ করেছে গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলা। বঙ্গবন্ধু যার নেতা। আমি, আপনি সকল বাঙালী যে স্বাধীনতার অগ্নিরথের আরোহী। পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকার, রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় সমঅংশীদারিতু দেয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না করাচী ও ইসলামাবাদের শাসক চক্রের। তারা চেয়েছে বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক কলোনী প্রতিষ্ঠা করতে। আর এই কলোনী শাসনের জন্য চেয়েছে বাঙালীর উপর একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভুত্ব। সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের ততোধিক সংখ্যালঘু একটি আমলাতান্ত্রিক সামরিকচক্র গত তেইশ বছর বাংলাদেশকে শাসন করেছে, তাদের অনুগৃহীত তেইশটি পরিবার বাংলাদেশেকে যথেচ্ছ শোষণ করেছে, তাদের পণ্যের একচেটিয়া বাজার করে রেখেছে। আজকাল পাশ্চাত্যের কোন কোন খ্যাতনামা রাজনৈতিক ভাষ্যকার সম্পূর্ণ দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার অশ্বেতাঙ্গদের উপর মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গের শাসনের অনুরূপ। পিণ্ডির শাসকচক্র ও প্রিটোরিয়ার শাসকচক্রের ফ্যাসিস্ট, অগণতান্ত্রিক ও মানবতাদ্রোহী ভূমিকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বাঙালীর ভাষা, বাংলাদেশের সংস্কৃতি-এক কথায় যা কিছু বাঙালীর জাতীয় চেতনার মহত্তম প্রকাশ, ১৯৪৮ সাল থেকে তাকে বার বার ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে, এই একটিমাত্র লক্ষ্য থেকে। এবং সেই লক্ষ্য হল বাঙালীর রাজনৈতিক অধিকার হরণ। বাংলাদেশে পিণ্ডির একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা এই প্রভূত্বের বিরুদ্ধে, এই নির্মম শোষণ আর শাসনের বিরুদ্ধে যিনিই কথা বলেছেন, বাংলাদেশের বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, করাচী এবং পিণ্ডির শাসকচক্রের চোখে তিনিই হয়েছেন দেশদ্রোহী। বৃটিশ আমলের আমলা গোলাম মোহাম্মদ শেরে বাংলা ফজলুল হকের মত বরেণ্য নেতাকে বলেছেন দেশদ্রোহী, তার বিচার করতে চেয়েছেন। মীরজাফরের বংশধর ইস্কান্দার মীর্জা হুমকি দিয়েছেন, তিনি গুলি করে মারবেন বয়োবৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানীকে। ইংরাজ আজলের পা-চাটা সিপাই আইয়ুবের চক্রান্তে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেশের বাইরে সুদূর বৈরুতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছে। আজ আইয়ুবের বিশ্বাসঘাতক দক্ষিণ হস্ত ইয়াহিয়ার চক্রান্তে প্রাণপ্রিয় মুজিব ভাই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত। চলছে তার প্রাণ হননের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের এমন একজন বরেণ্য নেতা নেই, যিনি পিণ্ডির প্রাসাদ-চক্রীদের কাছ থেকে দেশদ্রোহী আখ্যা পাননি, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হননি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বাধিকারের দাবি যিনিই করেছেন, তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহীতার দায়ে। পিণ্ডির এই নির্মম পীড়ন-চিহ্ন আজ যারা বাংলাদেশের শরীরে। ১৯৪৭ সালের পর এমন একটি বছর নেই, যে বছর বাংলাদেশে রক্ত ঝরেনি, মায়ের বুক খালি হয়নি, সন্তানহারা বাপের বুকফাটা আর্তনাদ বাংলাদেশে আকাশ বিদীর্ণ হয়নি। বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখ কি একটি? ১৭ই মার্চ, ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ৭ই জুন, ২০ শে জানুয়ারি, ২৫ শে মার্চ কত রক্তাক্ত তাখির আর এই তারিখের বীভৎস বর্বরতার কথা বলবো? সবশেষের তারিখ এই ২৫ শে মার্চ তারিখ। ছাত্র-যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ব্যবসায়ী মজুর, ঘুমন্ত বস্তিবাসী নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে অকাতরে হত্যা করা হল একটিমাত্র উদ্দেশ্যে, এবং তা হল বাঙালীর স্বাধিকার হরণ। তাই বাংলাদেশ আজ বিদ্রোহী। স্বাধীনতার রক্তপতাকার নিচে জমায়েত হয়েছি আমরা কোটি কোটি বাঙালী। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর প্রিয় মুজিব ভাই। এই একটি নাম আজ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংগ্রামী প্রেরণা। বাঙালীর স্বাধিকার চেতনার সঙ্গে এই একটি সংগ্রামী মানুষকেও হত্যার জঘন্য ষড়যন্ত্র চলছে পিণ্ডির খুনী চক্রীদের মধ্যে। আমি সূর্যসম্ভাবনার বিশ্বাসী। বুড়িগঙ্গার পলিমাটিতে তৈরি নতুন জীবন সম্ভাবনাতেও আমি আস্থাবান। এত রক্ত আমরা দিয়েছি, এই রক্তপিচ্ছিল পরে স্বাধীনতার সূর্যোদয় অবশ্যম্ভাবী।