পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

234 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড আলোকে রাতের কমান্ডো আক্রমণের ধারা রচিত হবে। বার্তা যার হাতে দেওয়ার নির্দেশ তাকে আমি চিনি না। আমার হাত থেকে যিনি বার্তা নেবেন তিনিও আমাকে চেনেন না। কিন্তু উভয়ে উভয়কে প্রথম দৃষ্টিতে চিনে নেয়ার একটি বিশেষ সংকেত ছিল।আমাদের শার্টের বিশেষ একটি দৃশ্যমান স্থানে একটি বিশেষ চিহ্ন ছিল। আমরা দু’জন দু’জনকে চিনলাম এবং কৌশলে বার্তাটি হস্তান্তর করলাম। এরপর আমার কাজ শেষ। তেজগাঁর কোন এক স্থানে চলে যাবো পরবর্তী নির্দেশ গ্রহণের জন্য। অনেক চেষ্টা করে একটা বেবী ট্যাক্সি পাকড়াও করলাম। গ্যারিসন শহর ঢাকা নগরীতে বেবী ট্যাক্সি পাওয়া দুস্কর। চালকের অভাবে অধিকাংশ যানই মালিকদের গৃহে পড়ে রয়েছে। ২৫শে মার্চের মধ্যরাত থেকে পাইকারী হত্যাকাণ্ড চালানোর পর বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে অসংখ্য বেবী ট্যাক্সি চালকও মার্কিন ও চীনের বুলেটের শিকার হয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন জীবনধারণের তাড়নায় তাদের কেউ কেউ রাস্তায় বেবী ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়েছেন। কিন্তু রাস্তায়ও ভয়। কারণ ট্যাক্সিতে আরোহণ করে কিন্তু ভাড়া দেয় না। ভাড়া চাওয়ার দুঃসাহস দেখলে চালক সাথে সাথে ভারতীয় চর বা মুক্তিবাহিনীর এজেন্টে পরিণত হয়ে যান এবং এদের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার অবাধ অধিকার জল্লাদ বাহিনীর রয়েছে। এমনকি রাজাকারাও এ জাতীয় হত্যা চালাতে পারে। হত্যার জন্য কোন জবাবদিহি হয় না, বুলেটের হিসাব দিতে হয় না। এ জাতীয় হত্যার জন্যে উপরি বাহবা পাওয়া যায়। বেবী ট্যাক্সিতে আমি উঠে বসেছি। এমন সময় একজন দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ সৈনিক আমাদের থামাতে ইশারা করলো। সৈনিকটি কাঁধে একটি অটোমেটিক চীনা রাইফেল। রাইফেলের নলটি আমাদের দিকে উদ্যত নয় বলে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। তবু যেন আমার মনে হলো বেবী ট্যাক্সির দিকে প্রতিটি বুটের পদক্ষেপ যেন আমার মৃত্যুর সময়সীমাকে ঘটিয়ে আনছে। একটি চীনা সীসার গুলি আমাকে প্রাণহীন করে দেবে। যেমন ১০ লক্ষ বাঙালীকে তারা প্রাণহীন করে দিয়ে ৭ কোটি ৪০ লাখ বাঙালীকে রক্তের বদলা নেওয়ার জন্য অবিস্মরণীয় ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করেছে। কিন্তু না-সৈনিকটি আমাকে গুলি করল না। বাঙালীর জাত তুলে গালাগালিও করলো না। আমাকে লাথি মেরে বেবী ট্যাক্সি থেকে ফেলেও দিলো না। শুধু উর্দুতে জিজ্ঞেস করলো আমি কোথায় যাবো। আমি বললাম তেজগাঁ ফারমগেট। সে বেবী ট্যাক্সিতে উঠে বললো, আমিও ওদিকে যাবো। প্রতিবাদ করার সাহস আমার ছিল না। আমি সরে জায়গা করে দিলাম। সৈনিকটি কাঁধ থেকে রাইফেলটি হাতে নিয়ে তার দু’পায়ের ফাঁকে তা দাঁড় করিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। জিপিও ছাড়িয়ে, প্রেসক্লাব সামনে ফেলে হাইকোর্টের কাছে আসার পর নির্বাক সৈনিকটি সবাক হলো। সে আমার নাম জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম। জিজ্ঞেস করলো আমি মুসলমান কি না। বললাম নামেই তো বুঝতে পারছো। সৈনিকটি আবার চুপ করে গেলো। আবার সে মুখ খুললো। অনেকটা জনান্তিকেই যেন বললো- তোমরা বেশ আছো! তোমরা বেশ আছো! আমি এবার কথা জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম। আমি বললাম, আপনারাও তো বেশ আছেন। বাঙালী কেমন আছে একথা তাকে জানাবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। আমার কাছে যে হায়েনাটি বসে আছে কত বাঙালীর রক্ত তার দেহে লেগে রয়েছে। হয়তো আমার কোন বোন এ পশুটির লালসার শিকার হতে অস্বীকার করায় বেয়নেটের খোঁচায় জীবনকে আলিঙ্গন করেছে। আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না! তাই আবার বললাম- আপনারা তো বেশ আছেন। ভালো খাওয়া, ভালো পোশাক আর জীবনের নিরাপত্তা। প্রশ্নে একটু যেন জুলে উঠলো।