পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

235 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড বললো সে তার কথা। সুখে থাকার কথা। ঝিলামের সুদেহী দীর্ঘকায় যুবকটি বললো তার কথা। সে বললো- সকালে নাস্তা দেওয়া হয় এক চামচ সেমাই আর এক চামচ ভিটামিন। ব্যস। এ খাবার খেয়ে হয়তো বেঁচে থাকা যায়; কিন্তু যুদ্ধ করা যায় না। খাওয়ার মান অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই ক্ষিধে পেলেই সৈন্যরা দোকানে ঢুকে খেয়ে নেয়। পয়সা চাওয়ার সাহস করে না দোকানদাররা। একটি বিমর্ষ কণ্ঠ থেকে শব্দ ঝরে পড়ছিলো। আমি খেতেও পারিনে। খেতে গেলেই ভাইদের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার আম্মার মুখ ভেসে ওঠে। ভাবলাম ভাইদের হয়তো খুব ভালোবাসে। তাই বিদেশ, বাংলাদেশে যুদ্ধ করতে এসে ভাইদের কথা মনে করে কষ্ট পাচ্ছে। বললাম- তারা বুঝি ঝিলামে রয়ে গেছে? সৈনিকটি বললো- না। তারা মাশরেকী পাকিস্তানের মাটির নিচে শুয়ে আছে। এই সৈনিকটির চার ভাই বাংলাদেশের যুদ্ধে রত ছিল। তিন ভাই ফেনী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছে। আমার পাশে বসা এই জানোয়ারটি আরও অনেক জানোয়ারের মতো আমার বাংলাদেশের অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশু-হত্যার জন্য দায়ী। তার খাকী রং আমাদের অনেক অনেক রক্তে রঞ্জিত। তবু পশুটির সাথে আমি বসে রয়েছি বলে আমার চাঞ্চল্য চাপা রাখতে হলো। সে কাদো কাঁদো হয়ে বললো যে, সে তার মাকে কি জবাব দেবে। যে মায়ের চার সন্তান ছিল, এখন তার মধ্যে তিনজনই চিরদিনের জন্য অনুপস্থিত হয়ে গেছে। তেজগাঁ আসার পর সে নেমে পড়ে। আমি এবং বেবী ট্যাক্সি ড্রাইভার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। (ইলিয়াস আহমদ ছদ্মনামে সলিমুল্লাহ রচিত) রক্ত দিয়ে রেখে গেলাম ৬ অক্টোবর, ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বছরের অর্ধভাগ পেরিয়ে গেলো। গত ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছমাস পূর্ণ হয়েছে। একটি জাতির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে ছ'মাস সময় তেমন কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের কাছে এই ছ'মাস সময়ের ব্যাখ্যা অনেক বেশী, অনেক ভিন্নভাবে মূল্যবান। কেননা যে সামরিক এক নায়কতন্ত্রের হিসাব কষা ধারণা ছিলো মাত্র ৭২ ঘন্টার মধ্যে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, সেখানে ছ'মাস প্রতিনিয়ত সংগ্রামমুখর একটি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অস্তিত্ব আমাকে নিঃসন্দেহে সগর্বিত জবাব দেবার অধিকার দেয়, আমি গর্ববোধ করি। আমরা গর্ববোধ করি, আমরা যুদ্ধ করেছি। আমরা গর্ববোধ করি আমাদের বাঁচার সংগ্রামে। কারণ আমরা যুদ্ধ করে বেঁচে আছি, আমরা যুদ্ধ করে মরছি। আমাদের অস্তিত্ব আজ তাই পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্ত প্ৰভু, ভূস্বামী পুঁজিপতি কিংবা বর্বর সামরিকতন্ত্রের অনুগ্রহ নয়, আমাদের অস্তিত্ব আমাদের অর্জিত অধিকার। এ কারণে আমি গর্ববোধ করি। আমরা সবাই যুদ্ধ করে বেঁচে আছি কিম্বা বেঁচে থাকার জন্যে যুদ্ধ করছি, আমাদের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করার জন্য যুদ্ধ করছি- এ আমার অহংকার ও এ আমার সম্মান। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের অস্তিত্বকে আমরা নিরাপদ না করে পারি না, আমরা সে জন্য যুদ্ধ করছি। আমরা যুদ্ধ করছি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ। মনে পড়ে ছ'মাস আগের কথা। ২৮শে মার্চ ঢাকা থেকে বেরিয়ে চলেছি