পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

272 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড লেগেছিল। ও কিছু না, শত্রদের খতম না করা অবধি আমরা ক্ষান্ত হবো না। তার দৃঢ় জীবন্ত শব্দগুলো আমার বিস্ময় এনে দিল তারপর ওঁরা আমার কাছ থেকে বিদান নিয়ে চলে গেলেন সাইকেলে চেপে হাত নেড়ে ক্যাপ্টেন শাজাহান সাহেব বললেনঃ দানবের সাথে সংগ্রামের তরে- আমি হাত নেড়ে বললামঃ জয় বাংলা। (মুসা সাদেক রচিত) ঘুরে এলাম মুক্তাঞ্চল ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ অনেক ঝড়ঝাপ্টার পরেও- দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে বিধ্বস্ত হওয়া সত্বেও সহজ স্বাভাবিক সবুজ শ্যামলিমা সর্বত্র অক্ষুন্ন। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। গ্রামবাংলার সেই চিরন্তন দৃশ্যই দেখছিলাম দু'চোখ ভরে, আর পায়ে পায়ে এগিয়ে চলছিলাম সামনের দিকে। পথে ছোট একটি খাল পড়ল। এটি পার হয়ে যেতে হবে। দেখলাম খালের পুলটি ভেঙ্গে পড়ে আছে আর তার পাশ দিয়েই নতুন একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। হানাদার বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করার আগে গ্রামবাসীরা পুলটি ভেঙ্গে দিয়েছিল। এখন আবার তারাই নতুন করে সাঁকো তৈরী করেছে। খালের ওপারে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। সামনে বিধ্বস্ত একটি বাড়ি। না, কোন ঝড়ের তাণ্ডবে ওটি বিধ্বস্ত হয়নি। ইতিহাসের কলঙ্ক ইয়াহিয়ার উন্মত্ত জানোয়ারগুলো বাড়িটিকে জুলিয়ে দিয়েছে। এগিয়ে গেলাম বাড়িটির ভিতরে। কোন মানুষ নেই, আছে শুধু চাপ চাপ রক্ত। বাঁধানো উঠোনের এক প্রান্তে একটি কুকুরের মৃতদেহ পড়ে আছে। ওটির পায়ে গুলির চিহ্ন দেখতে পেলাম, পশুগুলোর হিংস্রতার কাছে কুকুরটিও রেহাই পায়নি। হ্যাঁ, বলছিলাম খুলনা জেলার একটি মুক্তাঞ্চলের কথা। ওই ফ্রন্টের মুক্তিবাহিনীর একটি ছোট দলের অধিনায়ক আমার বন্ধু আনোয়ার। গত পরশুদিন গিয়েছিলাম ওর ক্যাম্পে। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন অধিবাসী। তাদের মধ্যে একজন বললেন, যে বাড়িটি দেখলেন ওটি স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাড়ি। পশুগুলো তাকে এবং তার দুই পুত্রকে হত্যা করেছে এবং তার একমাত্র মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক যা শুনলাম তা হল, মাস্টার সাহেবের এক বছরের শিশুপুত্রটির পা ধরে একটি জানোয়ার সিমেন্ট বাঁধানো উঠানে সজোরে নিক্ষেপ করে শিশুটির মাথাটিকে চৌচির করে ফেলেছে। তখন আর একটি জানোয়ার পাকিস্তানী পতাকা একখণ্ড বাঁশের মাথায় লাগিয়ে শিশুটির মাথার ভিতরে পুতে দিয়ে পৈশাচিক আনন্দে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে চিৎকার করে উঠেছিল। এ ধরনের শত শত জল্লাদী তাণ্ডবের কথা শুনতে শুনতে উপস্থিত হলাম স্থানীয় বাজারে। সেখানে দেখলাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে। বাজারে বেশ লোক সমাগম হয়েছে। কেনাকাটার মাঝে আলাপ হচ্ছে কোন কোন এলাকা মুক্ত হলো, কটা জানোয়ার খতম হল ইত্যাদি হরেক রকমের কথা। প্রতিটি মানুষের দৃঢ় মনোবল দেখে সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বীর প্রসবিনী বাংলার আজ এক অভূতপূর্ব সাজ।