পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১০১

 আমরা দাবী করিয়াছিলাম অর্থনৈতিক গণতন্ত্র, শোষণমূলক ব্যবস্থার অবসান। অথচ আমরা পাইতেছি একদিকে মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থের অর্থনৈতিক একাধিপত্য, মোটা বেতনভোগী, ভোগ-বিলাস ও অপরদিকে অন্নহীন, বস্ত্রহীন কঙ্কালসার দরিদ্র জনসাধারণ- ইহাই কি ইসলামী সমাজতন্ত্র? না সমাজতন্ত্রের নামে প্রবঞ্চনা?

শিল্প বিপ্লব

 গত এক বছর হইল সরকারীমহল হইতে আশার বাণী শুনান হইতেছে যে পাকিস্তানে শিল্প বিস্তারের সম্ভাবনা প্রচুর। এক বিশেষ কমিটি গঠিত হইতেছে, ইংরাজ বিশেষজ্ঞদিগকেও মোটা টাকা দিয়া পরামর্শ দিবার জন্য আনা হইতেছে, কিন্তু অবস্থার একচুলও পরিবর্তন হয়নি। বাস্তব কর্মপন্থা ভিত্তিতে একটি কাজও শুরু হয়নি। আমাদের সরকার যতদিন বৃটিশ ও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদীদের তোষণ করিয়া পাকিস্তানের শিল্প বিস্তারের চেষ্টা করিবে ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবস্থাই চলিতে থাকিবে। কারণ সাম্রাজ্যবাদীরা নিজ স্বার্থে যতটুকু প্রয়োজন তার চাইতে একধাপও অগ্রসর হইবে না। পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রয়োজনের চেয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রয়োজনই তাহাদের কাছে ঢের বড় কথা এবং এইদিকে নজর রাখিয়াই তাহারা সব কিছু করিবে। মার্শাল পরিকল্পনা মারফৎ পশ্চিম ইউরোপের শিল্পপ্রধান দেশগুলিকে যেভাবে পদানত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাতে বেশ বুঝা যায় যে এই সাম্রাজ্যবাদী ধুরন্ধরেরা পাকিস্তানের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিতে মোটেই ছাড়িবে না। অথচ আমাদের কর্তৃপক্ষ তাহাদেরই দুয়ারে ধর্ণা দিতেছে। আমেরিকার কাছ হইতে তাহাদের শর্তে টাকা ধার করা বা আমেরিকার পুঁজিপতিগণকে দেশে শিল্প বিস্তারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো যে খাল কাটিয়া কুমীর আনিবারই শামিল হইবে একথা যে কোন সাধারণ লোকেই বুঝিতে পারে। অথচ চোখের উপরই দেখিতেছি পূর্ব্ব ইউরোপের নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ সাম্রাজ্যবাদীদের দাসত্বসুলভ শর্তে দেওয়া ঋণ ঘৃণায় প্রত্যাখান করিয়া নিজ শক্তির উপর নির্ভর করিয়াই অনেক দ্রুতগতিতে শিল্প বিস্তার করিতেছে। ১৯৭১ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে সোভিয়েট রাশিয়া আমাদের দেশের মত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়িয়াও সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মাথা বিকাইয়া না দিয়া নিজ শক্তির উপর ভরসা করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাহারা যদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতা সত্ত্বেও অতি দ্রুত শিল্প বিস্তার করিতে পারে তাহা হইলে আমাদের সরকার সাম্রাজ্যবাদীদের তোষণ করিয়াও গত এক বছরে এক ধাপও অগ্রসর হইতে পারেন নাই কেন?

 সোভিয়েট রাশিয়া পরাধীন দেশ শোষণ করিয়া বা সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ হইতে ঋণ করিয়া শিল্প বিস্তারের টাকা জোগাড় করে নাই। তাহারা টাকা জোগাড় করিয়াছে সকল কলকারখানা, খনি, যানবাহন, ব্যাঙ্ক ও আভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য ধনিক শ্রেণীর হাত হইতে দখল করিয়া রাষ্ট্রের হাতে আনিয়া জারের আমলের সকল ধার-দেনা অস্বীকার করিয়া। দেশী ও বিদেশী ধনিকদের হাতে মুঠা হইতে অর্থনৈতিক আধিপত্র কাড়িয়া লওয়ার ফলে একদিকে যেমন শ্রমিক শ্রেণীর মজুরী বাড়িয়াছে ও জিনিষের দর কমিয়াছে- এককথায় বলিতে গেলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল দিক দিয়াই আমরা যেন আরও পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ হইতেছি। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসমূহ জোর করিয়া আমাদের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইতেছে- ইহাই হইল আমাদের গত এক বছরের অভিজ্ঞতা।

গণপরিষদ

 স্বাধীন দেশের গঠনতন্ত্র রচনার ফলে যে মুষ্টিমেয় লোকের ভোটে এবং পরোক্ত নির্বাচন দ্বারা গণপরিষদ গঠিত হইয়াছিল এক বছরে একমাত্র পতাকা নির্ধারণ ছাড়া তাহা কোন কাজই করে নাই। জনসাধারণকে ভুলাইবার জন্য নামেমাত্র একটি গণপরিষদ খাড়া করিয়া রাখা হইয়াছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনা করিলে আমাদের গণপরিষদের অগণতান্ত্রিক ভিত্তি ও স্থবিরতা একটি লজ্জার বিষয় হইয়াছে। এইরূপ একটি গণপরিষদের কাছ হইতে আমরা বিপ্লবী পরিবর্তন আশা করিতে পারি কিভাবে? সকলের মনেই আজ এ প্রশ্ন জাগিতেছে বর্তমান পরিষদ কি কালের দাবীর সহিত তাল মিলাইয়া পুরাতন বৃটিশ