পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
২৩১

৪ঠা ফেব্রুয়ারী

 এই সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবার পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রায় ৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর এক সুদীর্ঘ মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। বৈকালে কর্মপরিষদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জননেতা মওলানা ভাসানী, আবুল হাশেম ও অন্যান্য রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা লীগ সরকারের জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলা ভাষার দাবী সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সেই দিনই ২১শে ফেব্রুয়ারী অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবীতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দেওয়া হয়।

২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রস্তুতি

 ৪ঠা ফেব্রুয়ারী থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সাধারণ ধর্মঘটের জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রচার প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঢাকার রাজনৈতিক আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে সমগ্র প্রদেশের জনমনে তখন বিক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে। স্বরাজোত্তর কালে সরকার বিভিন্ন উৎপীড়নমূলক নীতির মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনে যে প্রাণধ্বংসী ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছিল, তারই প্রত্যক্ষ আঘাতের ফলে জনসাধারণে সৃষ্টি খুলে গেছে, অন্ধ মোহ কেটে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে ভাষার কণ্ঠরোধ করার নতুন ষড়যন্ত্র তাদের অসন্তোষকে দ্বিগুণতর করে দিয়েছে। সমগ্র প্রদেশ তখন প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। দিন দিন অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

 একদিকে ২১শে ফেব্রুয়ারীর জন্য জনসাধারণের ধর্মঘটের প্রস্তুতি অন্যদিকে ঐদিনই পূর্ববঙ্গ সরকারের বাজেট অধিবেশন উপলক্ষে গণ-শক্তির ভয়ে ভীত সরকার নিজেদের অসহায় মনে করে ২০শে ফেব্রুয়ারী রাত্রি থেকে ক্রমাগত এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারী করল।

 সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরের আবহাওয়ার অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা দিল। রিক্সাওয়ালা, গাড়ীওয়ালা, দোকানদার থেকে শুরু করে ছাত্র, কেরাণী, অফিসার ও রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত সর্বত্র প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হলো। সকল মহলেই ১৪৪ ধারার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল, সারা শহরময় একটা থমথমে ভাব বিদ্যমান থাকে।

 একদিকে চূড়ান্ত সরকারী দমননীতি অন্যদিকে জনসাধারণের তীব্র অসন্তোষ-এমতাবস্থায় কর্তব্য নির্ধারণের জন্য “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের” এর জরুরী সভা আহ্বান করা হল। সঙ্গে সঙ্গে সলিমুল্লাহ হলের ছাত্ররাও এক জরুরী বৈঠক সমবেত হয়ে পরিস্থিতির ব্যাপক পর্যালোচনা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

 সংগ্রামের কৌশল নির্দ্ধারণ করতে গিয়ে সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সদস্যদের মধ্যে তুমুল বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। জনাব ওলী আহাদ পরিস্থিতির সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিলেন যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনে অগ্রসর না হলে ভাষা আন্দোলনের এখানেই অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে, আর সরকারী দমননীতির নিকটও বশ্যতা স্বীকার করা হবে, সর্বোপরি জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। ইতিমধ্যেই সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রদের সভা থেকে দুইজন প্রতিনিধি সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সভায় এসে উক্ত হলের ছাত্রসাধারণের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সর্বসম্মত অভিমত জানিয়ে দেয়। এতদসত্ত্বেও উক্ত সভার অধিকাংশ সদস্যই সরকারী দমননীতিকে মেনে নেওয়ার পক্ষে মন্তব্য করেন এবং অবশেষে ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সঙ্গে সঙ্গে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, যদি ছাত্র ও জনসাধারণের কোন অংশ সর্বদলীয় কর্মপরিষদের এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন চালিয়ে যায় তবে স্বাভাবিকভাবেই এই সর্বদলীয় কর্মপরিষদ বাতিল হয়ে যাবে বলে ধরে নেওয়া হবে।