পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
২৬৬

নিয়ে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ স্বাভাবিকভাবেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা-সংস্কৃতিতে মুসলমান সম্প্রদায়কে অতিক্রম করে গেলেন।

 এদিকে মুসলমানদের অবস্থা কি? তাঁরা হয়ে রইলেন ‘না ঘরকা না ঘাটকা।’ বাংলাভাষাও ভাল করে চর্চা করলেন না, ইংরেজীকেও বয়কট করলেন। ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বিরাট মুসলিম জাতি অশিক্ষিত মৎসজীবীর পর্যায়ে নেমে আসতে বাধ্য হলেন।

 অন্যদিকে একদল “শেরিফ” সম্পূর্ণভাবে বাংলাভাষাকে বর্জন করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। একদিকে ইংরেজী বর্জন, অন্যদিকে “শেরিফ” দের বাংলা বর্জন করে উর্দু প্রচলিত করার প্রচেষ্টায় যে বিপর্যয় দেখা দেয় তাতে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

 কিন্তু আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হলো। বিশেষ করে গত ত্রিশ বছর ধরে এই অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষিত মুসলিম সমাজ ধীরে ধীরে মাতৃভাষার কদর বুঝতে শিখেছেন এবং ক্রমে ক্রমে বাংলা সাহিত্যের সাধনায় মুসলমানদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ নিশ্চিত পথে অগ্রসর হচ্ছিল। বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজও বাংলাদেশে গড়ে উঠল। সরকারী চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কৃষি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বাংগালী মুসলমানের ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করা গেল এবং বলাই বাহুল্য, এই নবগঠিত মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-সভ্যতার বাহন হল বাংলা-উর্দু বা ইংরাজী নয়।

 এরপর এল দেশ বিভাগ। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এদেশের সাড়ে চার কোটি জনসাধারণ আশা করে যে, স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সাথে সাথে বাংলা ভাষার মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের উন্নয়ন আরও ব্যাপক ও সর্বাত্মক হয়ে উঠবে। যে ভাষার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই একটি মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছে, সেই ভাষাকে কেন্দ্র করেই পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন চলবে, এটা অত্যন্ত ন্যায়সংগত ও স্বাভাবিক কথা; কিন্তু এখানেও একটা সংকটের সৃষ্টি করা হয়েছে। ইংরেজ সরকার বাংলাদেশের শাসন হাতে নেবার সাথে সাথেই যেভাবে ভাষাসংকটের সৃষ্টি করে, এবারেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইংরেজ ফারসী তাড়িয়ে আমদানী করেছিল ইংরেজী, এবার বাংলাকে হটিয়ে দিয়ে আমদানী করার কথা চলছে উর্দু।

 পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে বহিরাগত রাষ্ট্রভাষার স্থায়িত্বের নজীর নেই। ইরান ও তুরস্কের ইতিহাসে এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এই ভারত ও পাকিস্তানেও ইংরেজী শিখে বহু ভারতীয় যশের শিখরে আরোহণ করেছেন সত্যি কথা, কিন্তু ইংরেজ চলে যাবার সাথে সাথে ইংরেজী ভাষাকেও এদেশ থেকে পাততাড়ি গুটাতে হচ্ছে। তার স্থান দখল করতে যাচ্ছে ভারতে হিন্দী এবং পাকিস্তানে বাংলা ও উর্দু।

 বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে একশ্রেণীর লোকের কাছে একটা সস্তা যুক্তি প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে এই যে, বাংলা সংস্কৃতি ভাষা থেকে উৎপন্ন ও হিন্দু সাহিত্যিকদের দ্বারা পরিপুষ্ট বলে এই ভাষা ইসলামী ভাবধারা প্রচারের উপযোগী নয়। যাঁরা এই যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, তাঁদের জানা আছে (এবং না জানলে জানা উচিত) যে ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান ভাষা অল্পবিস্তর সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপন্ন। উর্দু ভাষায় অজস্র সংস্কৃত শব্দের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কারুর কোন সন্দেহ আছে কি? যদি না থাকে তাহলে কি উর্দু ভাষার জাত খোয়া গেছে বলতে হবে? আমাদের প্রশ্ন, পবিত্র কোরান শরীফ যে সময় অবতীর্ণ হয়, সে সময় আরবী ভাষা কাদের ভাষা ছিল? পুতুল-পূজারী পৌত্তলিক নাসারাদের নয় কি? যদি তাই হয়, তাহলে আরবী ভাষাকে পবিত্র ভাষায় মর্যাদা দেওয়া হয় কেন? আসলে, ভাষা ভাবপ্রকাশের বাহন মাত্র। ভাব যদি সমৃদ্ধ হয় এবং ভাষা যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে যে কোন সমৃদ্ধ ভাবধারা যে কোন শক্তিশালী ভাষায় প্রকাশ করা চলবে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ ভাষা- এই ভাষায় যদি ইসলামী ভাবধারার প্রচার ও প্রসার ঘটা অসম্ভব হয়, তাহলে বুঝতে হবে, হয় বাংলা ভাষা দুর্বল, নয় ইসলামী ভাবধারারই দুর্বলতা রয়েছে; কিন্তু এ দুয়ের যে কোন একটি স্বীকার করে নেবার প্রগলভতা কারুর আছে কি?