পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৩৯১

জবরদস্তি ক্রমে সমস্ত পাকিস্তানের ওপর কোন একটি ভাষা চাপিয়ে দিতে চায়, তারাই পাকিস্তানের দুশ্মন; তারাই পাকিস্তান প্রংস করবে।

 সুখের বিষয়, মুসলিম লীগ পার্লিমেণ্টারী পার্টির কিঞ্চিৎ সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে। তাঁরা উর্দু ও বাংলা উভয়কে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন, যদিও অন্য কতকগুলি ভাষার বিষয় তাঁরা বিবেচনা করতে স্বীকৃত হয়েছেন, কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আসনে আসীন দেখলেই আমরা চরিতার্থ হব না, যদি না সেই সঙ্গে আমরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধিকেও না পাই। তার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন পুর্ববঙ্গের সমস্ত সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং সাহিত্যের উন্নতি প্রকৃষ্ট পন্থা অবলম্বনের জন্য একটি সুপরিকল্পিত পন্থা নির্দেশ করা। এই জন্য এইরূপ সাহিত্য সম্মেলনের আজ বিশেষ গুরুত্ব দাঁড়িয়েছে। আশা করি সমবেত সাহিত্যিকগণ এ বিষয়ে অবহিত হবেন।

 আমরা চাই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ন্যায় একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি যার পরিচালনাধীনে প্রতি বৎসরে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে এইরূপ সম্মিলনীর অধিবেশন হবে। যাতে সাহিত্যিকরা আমাদের সাহিত্যের উন্নতির পন্থা নির্ধারণ ও ভাবের আদান প্রদানে সমর্থ হবেন। এই জন্য একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি স্থাপনের বা গ্রহণের কথাও এই সম্মেলনের প্রতিনিধিবর্গ বিবেচনা করবেন এই আশা করি। ঘরে ঘরে সাহিত্য সভা মন্দ কথা নয়; কিন্তু চাই একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি, যার নিজস্ব কার্যালয় থাকবে আর মুখপত্র থাকবে। আমরা অভিভক্ত পরাধীন বঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি স্থাপন করেছিলুম। এখন স্বাধীন পূর্ববঙ্গে কি একটি উন্নততর কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি স্থাপন করতে পারব না?

 বর্ত্তমান অবস্থায় পূর্ববঙ্গ সরকারের কার্য্যত সহানুভূতি ভিন্ন আমরা আমাদের সাহিত্যিক অভাব দূর করে তাকে সমৃদ্ধিশালী করতে পারি না। সেই জন্য একটি বাংলা একাডেমী বা বাংলা সাহিত্য নিকেতনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় আমাদের জনপ্রিয় পূর্ব বাংলা সরকার এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সকলের হয়তো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। এই জন্য আমি এই বাংলা সাহিত্য নিকেতন বলতে কি বুঝি, তা গত অক্টোবর মাসে সিলেটের এক জনসভায় যা বলেছিলুম, এখানে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি।

 এই বাংলা সাহিত্য নিকেতন বলিতে আমি বুঝি কলিকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ন্যায় বরং তদপেক্ষা উন্নততর ও ব্যাপকতর একটি প্রতিষ্ঠান। ইহার জন্য প্রথম প্রয়োজন সুন্দর পরিবেশের মধ্যে আধুনিকভাবে সজ্জিত একটি প্রশস্ত দ্বিতল গৃহ। তাহার সংলগ্ন পুস্তকালয়ে বাংলা সাহিত্যে উৎকৃষ্ট গ্রন্থগুলি বিশেষতঃ বাংলা ভাষায় মুসলমান রচিত, মুদ্রিত ও অমুদ্রিত সমস্ত বই ও পুঁথি থাকিবে। তাহাতে পাকিস্তারের ধর্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্বন্ধীয় আরবী, ফারসী, উর্দু, হিন্দী, ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান, ইতালিয়ান, ডাচ, স্পেনিস এবং রুশ ভাষায় লিখিত পুস্তক এবং সাহিত্যিক পত্রিকাগুলি রক্ষিত হইবে। ইহার একটি অনুবাদ বিভাগ থাকিবে। তাহার কার্য হইবে বিভিন্ন ভাষা হইতে পাকিস্তানের ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস সম্পর্কীয় মূল্যবান পুস্তকগুলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা। ইহার একটি পুস্তক প্রকাশ বিভাগ থাকবে তাহা হইতে বিভিন্ন ভাষায় এবং মুসলমান রচিত মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের সংস্করণ প্রকাশিত হইবে। এই বাংলা সাহিত্য নিকেতনের সহিত পাঠকক্ষ, গবেষণা প্রকোষ্ঠ এবং গবেষণাকারীদের জন্য বাসভবন থাকিবে।

 “সৌভাগ্যক্রমে আমরা মরহুম আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সাহিত্যসাগর সাহেবের সংগৃহীত অমূল্য পুঁথিগুলির অধিকাংশ পাইয়াছি এবং তাঁহার অবশিষ্ট পুঁথিগুলিও পাইতে আশা করি। কিন্তু আরও অনেক মুসলমান লিখিত প্রাচীন পুঁথি অযত্নে, গৃহদাহ, জলপ্লাবন বা কীটদষ্ট হইয়া চিরতরে বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে। ব্যাপকভাবে এই সকল পুঁথি আহরণের জন্য কর্মচারী নিয়োগ এবং অর্থ ব্যয় করিতে হইবে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে এই পূর্ববঙ্গ হইতেই ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা সংগৃহীত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছে। চেষ্টা করিলে লোক-সাহিত্য এখনও সংগ্রহ করা যাইতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও