পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৬৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৬৪৬

 বিভিন্ন দেশীয় শব্দভাণ্ডার হইতে চয়ন করিয়া এই ভাষায় শব্দসম্ভার সমৃদ্ধিশালী করা হইয়াছে। স্বকীয়ত্ব বলিতে এই ভাষার কিছুই নাই। এই ভাষার দাবী অগ্রগণ্য হইতে পারেনা।

 আবার কেহ কেহ এই ভাষাকে মুসলমানী ভাষা হিসাবে দাঁড় করাইয়া ইহাকে রাষ্ট্রভাষারূপে চালাইতে চেষ্টা করিতেছেন। এই প্রচেষ্টা যে নিতান্তই ভাবপ্রবণতা, এ কথা কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। কারণ, প্রথমতঃ মুসলমানী ভাষা বলিয়া কোন স্বতন্ত্র ভাষার অস্তিত্ব নাই। তাহা হইলে মুসলমানগণ যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাকেই মুসলমানী ভাষা বলা যাইতে পারে। ইহা হইতে পারে যে, ইসলামের শিক্ষা, সংস্কৃতি যে-ভাষার মাধ্যমে প্রকটিত হইয়া উঠিয়াছে তাহাকেই মুসলমানী ভাষা বলা চলে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা মতে আরবী ভাষাকেই একমাত্র মুসলমানী ভাষা বলা যাইতে পারে। সুতরাং মসলমানী ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে এই যুক্তি বলে আরবী ভাষাকেই আমাদের রাষ্ট্রভাষা করিতে হয়। কিন্তু তাহার ফল কি হইবে, উহা সহজেই অনুমান করা যায়। তাহা হইলে দেখিতে পাই যে, ইসলামের ঐতিহ্যিক বহনের দাবীতে রাষ্ট্রভাষা হইবার যোগ্যতা বাংলারও নাই, উর্দুরও নাই। তবে পূর্ব প্রদর্শিত কারণে উর্দু হইতে বাংলার দাবীই বেশী যুক্তিসংগত।

 দেখা যাইতেছে যে, ইসলামের ভাবধারাকে বাংলার সাহায্য নিতেই হইবে। কিন্তু এই কথা অনস্বীকার্য যে, বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে ইসলামিক ভাবধারা ও কৃষ্টির প্রচার করিতে হইলে বাংলা ভাষাই কার্যকরী হইবে বেশী। কারণ মাতৃভাষার সাহায্যে কোন কিছু শিক্ষা না দিয়া একটা নূতন ভাষা শিখাইয়া ঐ ভাষার সাহায্যে এই শিক্ষা দিতে যাওয়া বোকামী হইবে মাত্র। নূতন কোন ভাষা শিক্ষা করিতেই এখন আমাদের অন্ততপক্ষে ৮/১০ বৎসর সময় অতিক্রান্ত হইয়া যাইবে এবং ইতিমধ্যে এতদ্দেশীয় মুসলমানগণ স্বীয় ঐতিহ্যিক চেতনোপলব্ধির ক্ষেত্র হইতে বহু পিছনে পড়িয়া থাকিবে। তাছাড়া বাংলাভাষায় বহু পূর্ব হইতে আরবী ও ফারসী ভাবধারার চর্চা হইতেছে। প্রাচীন যুগে রচিত পুঁথিগুলি ছিল এই বিষয়ের পুরোধা; বর্তমানেও বহু জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ নানা পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করিয়া এই প্রচারকার্য চালইতেছেন। অবশ্য এই কথা স্বীকার না করিয়া উপায় নাই যে, এই প্রচারকার্য বাংলা ভাষায় যথেষ্ট কম হইয়াছে। কিন্তু এতদিন এইলপ না হইয়া উপায় ছিল না। একে তো আমাদের রাজভাষা ছিল বিজাতীয় ও বিধর্মীয়, তার উপর বাংলা ভাষার উপর কর্তৃত্ব করিত হিন্দুগণ; সুতরাং নিজ ইচ্ছামত প্রচারকার্য চালাইতে পারা যাইত না। এখন যদি আবার বাঙ্গালীর উপর উর্দু ভাষাভাষীদের কর্তৃত্বভার আনিয়া চালাইয়া দেওয়া হয়, তবে উহাকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বই আর কিছুই বলা চলিবে না।

 ইহা ব্যতীত ব্যাকরণের দিক দিয়াও উর্দু অপেক্ষা বাংলার দাবী যুক্তি সাপেক্ষে। প্রকৃত উর্দু অর্থাৎ সাহিত্যিক উর্দু অত্যন্ত জটিল। ক্রিয়াপদের লিঙ্গভেদ হইতে আরম্ভ করিয়া ব্যাকরণের অন্যান্য জটিলতা এত অধিক যে, স্বল্পায়াসে এই ভাষা শিক্ষা করা যায় না। পক্ষান্তরে বাংলা ভাষার জটিলতা উর্দু হইতে বহু অংশে কম। একথা অবশ্যই ঠিক যে, বাংলা শিক্ষার্থীর পক্ষে র, ড়, ষ, স, শ, ন, ণ প্রভৃতির পার্থক্য সঠিক অনুধাবন করা কষ্টকর। কিন্তু ইদানীং ভাষাবিদগণ প্রাচীন বর্ণমালা, ব্যাকরণ ও বানান প্রথার আমুল পরিবর্তনের প্রবৃত্ত হইয়াছেন,যাহার ফলে আশা করা যায়, সুসংস্কৃত হইয়া বাংলা ভাষা, বর্ণমালা, ব্যকরণ ও বানানের দিক হইতে ইংরাজীর ন্যায়ই সহজ এবং সকলের বোধগম্য হইবে। ইতিমধ্যেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা বানান পদ্ধতির সংস্কার সাধন করা হইয়াছে, ফলে ফলে বানান এখন যথেষ্টসহজ হইয়া গিয়াছে। অবশ্য এই প্রথা এখনও ব্যাপকভাবে সাহিত্য ও পাঠ্যপুস্তকে প্রচারিত হয় নাই। কিন্তু আবশ্যকবোধে প্রচলিত করিয়া লইতে বেশী দেরী হইবারও কোন কারণ নাই। অপরদিকে উর্দুর ব্যাকরণের জটিলতার কথা ছাড়িয়া দিলেও বর্ণমালাগত দুর্বোধ্যতাও উপেক্ষণীয় নয়। রে, ডে, দাল, যাশ প্রভৃতি শব্দের বাক ভুলতার দরুন প্রথম শিক্ষার্থীর পক্ষে উর্দু শিক্ষা দুরূহ হইয়া পড়ে। এবং এই সব দুর্বহ দুহতাকে সরল করিবার কোন প্রয়াসই অদ্যাবধি ঐ ভাষার পণ্ডিতগণ করেন নাই। উর্দু অর্থাৎ চলতি বাজারী উর্দুর ব্যাকরণগত জটিলতা অপেক্ষকৃত কম হইলেও উহাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্থান দেওয়া যাইতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে উহা কোন ভাষাই নয়বাংলা, হিন্দী, ইংরেজী প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষার শব্দাবলীর সমাহারে গঠিত এক আজব চিজ বলা যাইতে পারে। যে ভাষার কোস স্বকীয়ত্ব নাই, কোন সাহিত্য নাই, যে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা জাতির বা দেশের পক্ষে কলংকজনক বই কি। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষর দাবীর যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দিহান হইবার কেও কারণ নাই।

 এখন প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, পূর্ব পাকিস্থানের রাষ্ট্রভা বাংলা হইলে পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত এই রাষ্ট্রের যোগসূত্র কি প্রকারে স্থাপিত হইবে। এই প্রশ্নের উত্তর প্রধানতঃ নির্ভর করে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর। কোন কোন বিষয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রসমূহের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব থাকিবে সেই বিষয়টি পরিষ্কার হইলেই এই প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাইবে। বর্তমান ব্যবস্থা মতে অর্থাৎ দেশরক্ষা, অর্থ বিভাগ