পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৭৪৭

না রাখিলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বজায় থাকিবে না। “পাকিস্তান লাভের জন্য তাহা হইল আমাদের সংগ্রাম করা বৃথা হইয়াছে। হিন্দু-মুসলমান যদি এক জাত হিসাবে পরিগণিত হয়, তাহা হইল অদূর ভবিষ্যতে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান এক হইয়া যাইবে” ইত্যাদি। এইখানেই তাহারা ক্ষান্ত হন নাই, ইতিমধ্যে তাহারা ইহাও বুঝিতে পারিয়াছেন যে, “যুক্ত নির্বাচনের সমর্থকরা বাহিরে স্বার্থেই রাষ্ট্রের এই শত্রুতা করিতেছে- ইসলামকে বিপন্ন করিতেছে”। ইহাই পৃথক নির্বাচনের সমর্থকদের সবচয়ে “মূল্যবান” বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ইহা ছাড়া অন্যান্য যে, যুক্তি তাহারা দিয়া থাকেন সেগুলো হইতেছে “মুসলমানরা বোকা; সুতরাং হিন্দুরা সংখ্যায় অল্প হইলেও যেহেতু তাহারা বুদ্ধিমান, সেহেতু মুসলমানদের নির্বাচনে জয়লাভ করার কোনই আশা নাই। মুসলমানদের উপর ইসলামের রক্ষকদের কি অপূর্ব শ্রদ্ধা! পৃথক নির্বাচনের সমর্থকগণ তাদের দাবীর সমর্থনে যে সমস্ত যে যুক্তি দিয়া থাকেন, তাহা মোটামুটিরভাবে এরূপ। এখন আমাদের বিচার করিয়া দেখিতে হইবে যে তাহাদের দাবীগুলো পূরণ করা হইলে পাকিস্তানের মঙ্গল হইবে কিনা।

 যুক্ত নির্বাচনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোপ ও সন্দেহ সৃষ্টি করার আয়োজন চলিতেছে, তাহা নিছক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার প্রয়াস ইহা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একথা সত্য যে পাকিস্তান লাভের পিছনে কায়েদে আযম জিন্নাহর দুই জাতিতত্ত্ব কাজ করিয়াছে। কিন্তু পাকিস্তান লাভের পিছনে উহাই সব নহে। পাসিত্মান লাভের পর কায়েদে আযম জিন্নাহও দৃঢ়তার সহিত ঘোষণা করিয়াছেন যে, “আজ আর হিন্দু, হিন্দু নহে; মুসলমান; মুসলমান নহে, সকলে মিলিয়াই আজ আমরা পাকিস্তানী।” বাস্তব দ্রষ্টা, কায়েদে আযম জিন্নাহ বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, সাম্প্রদায়িকতার অবসান না হইলে পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইয়া যাইবে। দীর্ঘ দুই শত বৎসরের সাম্রাজ্যবাদী শোষণে জনগণের জীবনে যে চরম সংকটের সৃষ্টি হইয়াছিল, জনগণ সেই সংকট হইতেই মুক্তি চাহিয়াছিল। এবং জনগণের এই মুক্তির আকাঙ্খাই জনগণকে পাকিস্তান লাভের প্রেরণা যোগাইয়াছে। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগও খাদ্য সমস্যা, জমিদারী প্রথা, ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রভৃতি জনসমস্যার মূল দাবীগুলিকে উত্থাপন করিতে হইয়াছিল। জনগণ ইহাই বিশ্বাস করিয়াছিল মুসলিম লীগ আজ পর্যন্ত দুই জাতিতত্ত্বকে প্রচার করিয়া আসিতেছে। কিন্তু জনগণ মুসলিম লীগকে তবুও নির্মূল করিয়াছে। ইহার একমাত্র কারণ এই যে, মুসলিম লীগ জনগণের মূল সমস্যার কোনই সমাধান করে নাই। ইহা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জনগণের সমস্যার সমাধান হইবে পাকিস্তান লাভের পিছনে জনগণের এই বিশ্বাস কাজ করিয়াছে। এই বিশ্বাসর তাৎপর্য লীগ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করিয়াছিলেন, তাই জনগণের মুক্তি এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা অদূর ভবিষৎতে শোষক নেতৃত্বের শোষণ যন্ত্রকে নির্মূল করিবার পথে পরিচালিত হইতে পারে সেই আশংকা “মুসলিম জমিদার,” হিন্দু জমিদার” মুসলিম শোষক” হিন্দু শোষক” মুসলিম অত্যাচারী, হিন্দু অত্যাচারী” প্রভৃতি শ্লোগান দ্বারা জনগণকে বিভেদ, বিভ্রান্তি ও সাম্প্রদায়িতকার পথে পরিচালিত করিয়া লোক দেখানো ধর্মের কর্মে নিজ স্বার্থকে বজায় রাখার প্রয়াস পাইয়াছে।

 পাকিস্তান লাভের পরে দুই জাতিতত্ত্ব দ্বারা পাকিস্তানের জনগণকে দুইটি ভিন্ন জাতিতে পরিণত করা এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উহাকে রূপদান করার প্রয়াস পাকিস্তানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করিবে। দুই জাতিতত্ত্ব পাকিস্তান লাভের মূল দাবী হইলে পাকিস্তান লাভের সাথেই সাথেই সেই দাবী পূরণ হইয়াছে বলিয়া ধরিয়া লইতে হইবে। নতুবা হিন্দু ও মুসলমানকে যদি পাকিস্তানের ভিতর দুইটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে পরিগণিত করা হয় তাহা হইলে দুই জাতিতত্ত্বের পণ্ডিতবর্গের সামনে মাত্র একটি পথই খোলা থাকিবে। সেইটি হইতেছে এই “হিন্দু জাতির” জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানে একটি অংশকে ছাড়িয়া দেওয়া, হিন্দুরা এই “ইসলামের রক্ষকদের নিকট ন্যায়তঃ ও যুক্তসঙ্গতভাবে দুই জাতিতত্ত্বে ভিত্তিতে তাহাদের আবাসভহমি দাবী করিতে পারে। এর পরিণতি, পাকিস্তান খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া ও পাকিস্তারে বিলুপ্তি। যুক্তি নির্বাচনে সমর্থনকারীদের যাহারা পাকিস্তানের শত্রুআখ্যা দিয়া নিজেদের দুই জাতিতত্ত্বকে পেশ করিবার ভূমিকা সৃষ্টি করিতেছে, তাহাদের দাবী পূরণ করিতে হইলে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন না করিয়া উপায় নাই।