পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৩১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

282 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড যত বাড়িয়াছে ততই তীব্রতর হইয়াছে তার দুর্জয় জাতীয়তাবদী চেতনা। বাঙ্গালী জাতির এই জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং নিজেই নিজের ভাগ্য নিয়ন্তা হওয়ার দুর্জয় বাসনা চরম রূপ লাভ করিয়াছে বিংশ শতাব্দীর অপরাজেয় জাতীয়তাবাদী গণশক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্বার সংগ্রামের নির্ভীক সিপাইসালার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ছয় দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধিকার চাহিয়াছিলেন। কিন্তু এই আপাতঃ লক্ষ্য স্বাধিকারের দাবীর অন্তরালে যে চূড়ান্ত লক্ষ্য নিহিত ছিল সে সম্পর্কেও তিনি জনগণের কাছে আভাস দিতে ভুল করেন নাই। ১৯৭০ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারই প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বাংলার ছাত্র, যুবক, শ্রমিক জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলিয়াছেন, “ছয় দফা যদি মানিয়া না নেওয়া হয় তবে কয় দফা দিতে হইবে আমার জানা আছে। যখন দরকার হইবে আমিই বিপ্লবের ডাক দিব, তোমরা প্রস্তুত থাকিও।” ষড়যন্ত্রকারী এবং শাসককল যে সহজে জনগণকেই রাষ্ট্ৰীয় ব্যবস্থার সকল শক্তির উৎস বলিয়া মানিয়া নিয়া তাদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করিবে না বঙ্গবন্ধু ইহা জানিতেন। আর জানিতেন বলিয়াই ভোট চাহিতে গিয়াও তিনি জনগণের প্রতি সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়াছেন। বাংলার মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বলিয়াছেন আমি তোমাদের কাছে দুইটি জিনিষ চাইঃ একটি তোমাদের ভোট, আর একটি যখন আন্দোলনের ডাক দিব তখন সর্বশক্তি লইয়া দুশমনের মোকাবিলা করিবার ওয়াদা। প্রলয়বিধ্বস্ত দুর্ভাগা বাংলার উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শনে শেষে ঢাকা ফিরিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩শে নভেম্বর হোটেল শাহবাগে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এই সম্মেলনে দেশ-বিদেশের দুইশোর ও বেশী সাংবাদিক যোগদান করেন। এই সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথেই লক্ষ্যে পৌছিতে চাই। নির্বাচন যদি হয় ভাল। আর যদি নির্বাচন না হয় সংগ্রামের মাধ্যমেই আমরা অধিকার আদায় করিব। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের যে দশ লক্ষ ভাইবোন প্রাণ হারাইয়াছে তাদের কাছে আমরা ঋণী। তাদের কাছে এই আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকারঃ প্রয়োজনবোধে আরো দশ লক্ষ বাঙ্গালী শহীদ হইব। তবু আমরাই আমাদের দেশ শাসন করিব- বাংলাকেই করিয়া তুলিব বাংলার ভাগ্যবিধাতা। এই পটভূমিতে গত বছর ৭ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে গমন করে। তাদের এই দিনের রায়-নিজেরাই নিজেদের শাসক ইহবার রায়- বাংলাকেই বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা করা রায়। আর এই রায় নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নবদিগন্তের সূচনা করিয়াছে। আজিকার মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা এবং বৈধতা সপ্রমাণেও তাই ৭ই ডিসেম্বরের রায়ের ভূমিকা অপরিসীম, অনস্বীকার্য। ৭ই ডিসেম্বরের সেই রায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক-শোষকের দল মানিয়া নেয় নাই। কিন্তু বাংলার মানুষও শক্তির দাপটের কাছে মাথা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম ২৬শে মার্চ। মাত্র আট মাস আগে বাঙ্গালী জাতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার পতাকা আর সমরাস্ত্র হাতে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। এই আট মাসে ২৫শে মার্চের কালো রাত্রির হিংস্র জল্লদী ছোবল, মানবেতিহাসের নজিরবিহীন বীভৎস নারকীয় গণহত্যাযজ্ঞ, হানাদার বর্বর ডালকুত্তা বাহিনীর পাশবিক নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ আর নির্যাতনের নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়া, আকস্মিক আঘাতের প্রাথমিক বিপর্যয় কাটাইয়া, স্বাধীনতার দুর্গম বিসর্পিল পথের প্রান্তে প্রান্তে শাঠ্য ষড়যন্ত্র বাধাবিপত্তির মরণ ফাঁদ এড়াইয়া আপোষহীন সংকল্পে সামনে আগাইয়া পাল্টা আঘাত হানিতে অনেকটা সময় কাটিয়া গিয়াছে বাঙালী জাতির। কিন্তু কৰ্তব্যে অবহেলা আর এতটুকু কালক্ষেপণও তারা করে নাই। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বাধীনতার স্বৰ্গতোরণের নির্দিষ্ট পথে আগাইয়া চলিয়াছে বাংলার মানুষ অপ্রতিহত বেগে। বুকে বুকে হানাদার দুশমনের উপর নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণের লেলিহান চিতাগ্নি, অন্তরে অন্তরে স্বাধীনতার দুর্মর স্বপ্নের বন্যা, আর বাংলার মুক্তি সেনাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল শিখায় জুলিয়াছে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রদীপ্ত আলোকমালা। সেই আলোতেই পথ দেখিয়া সূর্যের আলোর রাজত্বে। এবার চরম আঘাত হানিবার পালা। বাংলাদেশের দিকে দিকে দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে দুশমনের উপর