পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

 বাংলা ভঙ্গীওয়ালা ভাষা। ভাবপ্রকাশের এরকম সাহিত্যিক রীতি অন্য কোনো ভাষায় আমার জানা নেই।

 অর্থহীন ধ্বনিসমবায়ে শব্দরচনার দিকে এই ভাষায় যে ঝোঁক আছে তার আলোচনা পূর্বেই করেছি। আমাদের বোধশক্তি যে শব্দার্থজালে ধরা দিতে চায় না বাংলা ভাষা তাকে সেই অর্থের বন্ধন থেকে ছাড়া দিতে কুণ্ঠিত হয় নি, আভিধানিক শাসনকে লঙ্ঘন ক’রে সে বোবার প্রকাশ-প্রণালীকেও অঙ্গীকার করে নিয়েছে।

 ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলিতে তার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি। পোকা কিল‍্বিল্ করছে: এ বাক্যের ভাবটা ছবিটা কোনো স্পষ্ট ভাষায় বলা যায় না। ‘খিট্‌খিটে’ শব্দের প্রতিশব্দ ইংরেজিতে আছে irritable, peevish, pettish; কিন্তু ‘খিট্‌খিটে’ শব্দের মতো এমন তার জোর নেই। নেশায় চুরচুর, হওয়া, কট্‌মট্ ক’রে তাকানো, ধপাস্ ক’রে পড়া, পা টন্ টন্ করা, গা ম্যাজ‍্ ম্যাজ্ করা: ঠিক এ-সব শব্দের ভাব বোঝানো ধাতুপ্রত্যয়ওয়ালা ভাষার কর্ম, নয়। ইংরেজিতে বলে creeping sensation, বাংলায় বলে ‘গা ছমছম করা’; আমার তো মনে হয় বাংলারই জিত। গুটিকয়েক রঙের বোধকে ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ করায় বাংলা ভাষার একটা আকুতি দেখতে পাওয়া যায়: টুক‍্টুকে টক্‌টকে দগ্দগে লাল, ধব‍্ধবে ফ্যাক‍্ফেকে ফ্যাট্‌ফেটে সাদা, মিস‍্মিসে কুচকুচে কালো।

 বাংলায় শব্দের দ্বিত্ব ঘটিয়ে যে ভাবপ্রকাশের রীতি আছে সেও একটা ইশারার ভঙ্গী, যেমন: টাটকা-টাটকা গরম-গরম শীত-শীত মেঘ-মেঘ জ্বৱ-জ্বর যাব-যাব উঠি-উঠি। অর্থের অসংগতি, অত্যুক্তি, রূপক-ব্যবহার, তাতেও প্রকাশ হয় ভঙ্গীর চাঞ্চল্য; অন্য ভাষাতেও আছে, কিন্তু বাংলায় আছে প্রচুর পরিমাণে।

 আকাশ থেকে পড়া, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া, হাড় কালী করে দেওয়া, পিটিয়ে লম্বা করা, তেসে দেওয়া, গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ানো, নাকে তেল দিয়ে ঘুমোনো, তেলে বেগুনে জ্বলা, পিত্তি জ্বলে

১১৮