পাতা:বাংলার পুরনারী - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কাজল রেখা VS এই গল্পটি সম্ভবতঃ বৌদ্ধ যুগে পরিকল্পিত হইয়াছে। ইহাতে খুব বড় বড় বিপদ ও দুঃখের কথা আছে, কিন্তু "চণ্ডীর চৌতিসা’ অথবা ‘শ্ৰীকৃষ্ণের শত নাম’ নাই। বিপদের সময় ভগবানের সহায়তার জন্য চেষ্টা নাই—নিজের সহিষ্ণুতা ও উদারতা মাত্ৰ লইয়া কাজল সর্ব বিপদের অবস্থার সম্মুখীন হইয়াছে। সেই যুগে মেয়েদের চিত্রাঙ্কন, রন্ধন, শিল্প প্রভৃতির বিশেষ চর্চা হইত। কিন্তু কোন স্থানেই ব্ৰাহ্মণ্যের প্রভাব দৃষ্ট হয় না। চিত্রাঙ্কণের সময় গণেশের নাম চিত্রকরীর মনে প্ৰথম উদয় হয় নাই, রন্ধন-শালায় অন্ন-পূর্ণ বা লক্ষ্মীকে প্ৰণাম করিয়া কাজল রাধিতে বসেন নাই। দেব দেবীর কথা আছে,- তাহা চালচিত্রের ন্যায়, কিন্তু বৌদ্ধাধিকারে প্রতিষ্ঠিত কতকগুলি পল্পীদেবতার নাম পাওয়া যায়- যথা ডাড়াই, ডাকিনী, সেওয়া গাছতলায় বনদেবী ইত্যাদি । সমস্ত অবস্থান্তরের মধ্যে বিপদের ঘোরে এবং নৈরাশ্যের আঁধারে কাজলরেখার যে দেবী-মূৰ্ত্তি ফুটিয়াছে তাহা সূৰ্য্যরশ্মির মত কিরণজাল প্ৰক্ষেপ করিয়া বিয়োগবিধুর গল্পটীকে স্বর্ণচ্ছটায় মণ্ডিত করিয়াছে এবং কাজলের ক্ষমাশীল আত্মদান-সমুজ্জল ও সহিষ্ণু পরিচর্য্যার মূৰ্ত্তিকে বরণীয় করিয়া দেখাইতেছে। চতুর্দিকে লবণ-সমুদ্র, মধ্যে ক্ষুদ্র দ্বীপের ক্ষুদ্র দীঘিটির জল এত মিষ্ট কিরূপে হইল ? কাজলের স্বভাব সেইরূপ মিষ্ট । তাহার উপর দিয়া কৃতান্নতা, নিষ্ঠুরতা ও মিথ্যার বন্যা বহিয়া যাইতেছে কিন্তু এই অমৃতকুণ্ডের জল কেহ বিস্বাদ করিতে পারে নাই। কাজল অমৃত লোকের মানুষ, কি সাধ্য পার্থিব আবর্জনা তাহাকে মলিন করিবে ? “কৃষ্টং খৃষ্টং ত্যজাতি ন পুনঃ চন্দনঃ চারুগন্ধং” এই অমর পুষ্পের সুরভি নষ্ট করিবার অধিকার জড়শক্তির নাই। এই কাজলের চিত্রে হিন্দু রমণীর যে আদর্শ আছে, তাহা এক সময়ে বঙ্গের পল্লী ও নগরের আকাশে বাতাসে ছিল ; সেই ত্যাগ ও সহিষ্ণুতা ও সেই প্ৰাণ-দেওয়া নীরব সেবা ও সর্বস্ব-হারার জীবন উৎসর্গ কতবার সকলের গোচর হইয়াছে, কখনও বা লোক-চক্ষুর অন্তরালে কোনরূপ ঘোষণা বা স্মৃতি না রাখিয়া তাহাদের লোপ হইয়াছে। কিন্তু এই সকল মহৎ গুণ কোন কালেই ব্যর্থ হইবার নহে। বনের কুসুম শত শত ঝরিয়া