পাতা:বাংলার পুরনারী - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাণী কমলা ( তাহা মেচ জাতীয় শিল্পীরা তৈরী করিয়াছে, কেহ কেহ সুগন্ধি তৈলের বাটী লইয়া চলিয়াছে,—নানারূপ কেশ-তৈলের সুরভিতে সমস্ত পল্লী যেন সুবাসিত হইয়াছে। কাহারও হস্তে সাদা, লাল, নীল পুষ্পের সাজি, কাহারও হস্তে দেব-পুজার জন্য শ্যাম দুৰ্বাদল। সেই অন্ধকার রাত্রে বিচিত্ৰবেশিনী পরিচারিকার রাণী কমলাকে লইয়া সোমেশ্বরী নদীর কূলে চলিয়াছেন। যিনি অসূৰ্য্যাম্পশ্যা ও দেবনারীর মত দুৰ্লভ-দর্শন, সেই মহারাণী অন্ধকার রাত্রে রাজপথ দিয়া পদব্রজে চলিয়াছেন ! ঘন ঘোর অন্ধকার রাত্রির আকাশে যেন কালো বস্ত্রের আচ্ছাদনের উপর শত শত সোণার চাপা ফুটিয়া আছে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেই তারাগুলি একটী নীলকৃষ্ণ ফুলের বৃক্ষের মত দেখা যাইতেছে। সেই আঁধারে সোমাই নদী উজান পথে ছুটিয়াছে। নদীর তীরে আসিয়া দাসীরা সুরঞ্জিত গামছা দ্বারা রাণীর শ্ৰীঅঙ্গ মার্জনা করিল, কেহ কেহ গন্ধ তৈল দিয়া রাণীর চুল সুবাসিত করিল। নানারূপ প্রসাধনের পর রাণী জলে নামিয়া সুন্নান করিলেন, দাসীরা তাহার অঙ্গ কোমল গামছা দ্বারা মুছাইয়া দিল, আদ্ৰ বস্ত্র ছাড়াইয়া “অগ্নিপাটের শাড়ী” পরাইল । স্নানান্তে দেবীপ্রতিমার মত কমলারাণী পূজায় বসিলেন—তিনি ফুলদুৰ্ব্বাদল ও ধান প্ৰভৃতি মাঙ্গলিক দ্রব্য দ্বারা সোমাই নদীকে পূজা করিয়া প্রার্থনা করিলেন, “আমি আজ আমার প্রাণপতির বিপদ উদ্ধারের জন্য আত্মোৎসর্গ করিব,—তুমি নদী সাক্ষী থাকিও,-নদীর তীরে এই শ্যামল শ্ৰী তরুরাজি তোমরা সাক্ষী থাকিও, আমি স্বামীর জন্য আত্মদান করিব। আমার স্বামীর পূর্বপুরুষেরা যেন উদ্ধার পান, পুকুর যেন জলে ভৰ্ত্তি হয়। হে আকাশের তারাসমূহ তোমরা সাক্ষী থাকিও, হে দেবধৰ্ম্ম—তোমরা সাক্ষী থাকিও।” স্বামীর শুভচিন্তায় আত্মহারা রাণী পুষ্প-বিল্বদল সোমাই নদীতে অৰ্পণ করিলেন। তঁহার মনে হইল কেহ যেন অভয় দিয়া তাহার প্রার্থনা সিদ্ধ হইয়াছে এই আশ্বাস দিলেন । তখন মণিমাণিক্য-খচিত সোণার কলসী ভরিয়া সোমাই নদীর জল তুলিয়া ধীরপদে তিনি রাজপথে আসিলেন ; দেখিলেন, পূর্বকােশ ঝিকিমিকি করিতেছে, উষার পায়ের আলতার দাগ যেন মেঘে মেঘে খেলিতেছে। প্ৰভাতে নবজাগ্ৰত লোককোলাহল ক্রমেই বাড়িতেছে।