পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভাষার খেয়াল

ভাষা যে সব সময়ে ঘোগ্যতম শব্দের বাছাই করে কিংবা যোগ্যতম শব্দকে বাঁচিয়ে রাখে তার প্রমাণ পাই নে। ভাষায় চলিত একটা শব্দ মনে পড়ছে ‘জিজ্ঞাসা করা’। এ রকম বিশেষ্য-জোড়া ওজনে ভারী ক্রিয়াপদে ভাষার অপটুত্ব জানায়। প্রশ্ন করা ব্যাপারটা আপামর সাধারণের নিত্যব্যবহার্য অথচ ওটা প্রকাশ করবার কোনো সহজ ধাতুপদ বাংলায় দুর্লভ এ কথা মানতে সংকোচ লাগে। বিশেষ্য বা বিশেষণ রূপকে ক্রিয়ার রূপে বানিয়ে তোলা বাংলায় নেই যে তা নয়। তার উদাহরণ যথা— ঠ্যাঙানো, কিলোনো, ঘুমোনো, গুঁতোনো, চড়ানো, লাথানো, জুতোনো। এগুলো মারাত্মক শব্দ সন্দেহ নেই, এর থেকে দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট উত্তেজিত হলে বাংলায় ‘আনো’ প্রত্যয় সময়ে সময়ে এই পথে আপন কর্তব্য স্মরণ করে। অপেক্ষাকৃত নিরীহ শব্দও আছে, যেমন আগল থেকে আগলানো; ফল থেকে ফলানো, হাত থেকে হাতানো, চমক থেকে চম্কানো। বিশেষণ শব্দ থেকে, যেমন উলটা থেকে উলটানো, খোঁড়া থেকে খোঁড়ানো, বাঁকা থেকে বাঁকানো, রাঙা থেকে, রাঙানো।

 বিদ্যাপতির পদে আছে ‘সখি, কি পুছসি অনুভব মোয়’। যদি তার বদলে— ‘কি জিজ্ঞাসা করই অনুভব মোয়’ ব্যবহারটাই ‘বাধ্যতামূলক’ হত কবি তা হলে ওর উল্লেখই বন্ধ করে দিতেন।[১] অথচ প্রশ্ন করা অর্থে শুধানো শব্দটা শুধু যে কবিতায় দেখি তা নয় অনেক জায়গায় গ্রামের লোকের মুখেও ওই কথার চল আছে। বাংলা ভাষার ইতিহাসে যাঁরা প্রবীণ তাঁদের আমি শুধাই, জিজ্ঞাসা করা শব্দটি বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে বা লোকসাহিত্যে তাঁরা কোথাও পেয়েছেন কিনা।

  1. ‘বাধ্যতামূলক’ নামে যে একটা বর্বর শব্দ বাংলাভাষাকে অধিকার করতে উদ্যত, তার সম্বন্ধে কি সাবধান হওয়া উচিত হয় না? কম্পল্‌সরি এডুকেশনে বাধ্যতা ব’লে বালাই যদি কোথাও থাকে সে তার মূলে নয় সে তার পিঠের দিকে বা কাঁধের উপর, অর্থাৎ ওই এডুকেশনটা বাধ্যতাগ্রস্ত বা বাধ্যতাচালিত। যদি বলতে হয় ‘পরীক্ষায় সংস্কৃত ভাষা কম্পল্‌সরি নয়’ তা হলে কি বলা চলবে ‘পরীক্ষায় সংস্কৃত ভাষা বাধ্যতামূলক নয়।’ সৌভাগ্যক্রমে ‘আবশ্যিক’ শব্দটা উক্ত অর্থে কোথাও কোথাও চলতে আরম্ভ করেছে।