পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৬২
বাংলা শব্দতত্ত্ব

অনধিকার নিরোধ করা এত দুঃসাধ্য হয়েছে। ছাপাখানার অক্ষর-যোজকেরা সংশোধন মানে না। তাদের প্রশ্ন করা যেতে পারত যে, কানের এক ‘সোনায়’ যদি মূর্ধন্য ণ লাগল, তবে অন্য ‘শোনায়’ কেন দন্ত্য ন লাগে। ‘শ্রবণ’ শব্দের র-ফলা লোপ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার মূর্ধন্য ও সংস্কৃত ব্যাকরণ মতেই দন্ত্য ন হয়েছে। অথচ ‘স্বর্ণ’ শব্দ যখন রেফ বর্জন করে ‘সোনা’ হল, তখন মূর্ধন্য ণ-য়ের বিধান কোন্ মতে হয়? হাল আমলের নতুন সংস্কৃত-পোড়োরা ‘সোনা’কে শোধন করে নিয়েছেন, তাঁদের স্বকল্পিত ব্যাকরণবিধির দ্বারা– এখন দখল প্রমাণ ছাড়া স্বত্বের অন্য প্রমাণ অগ্রাহ্য হয়ে গেল। ‘শ্রবণ’ শব্দের অপভ্রংশ শোনা শব্দ যখন বাংলা ভাষায় বানান-দেহ ধারণ করেছিল, তখন বিদ্যাসাগর প্রভৃতি প্রাচীন পণ্ডিতের বিধানকর্তা ছিলেন– সেদিনকার বানানে কান সোনা প্রভৃতিরও মূর্ধন্যত্ব প্রাপ্তি হয় নি। কৃষ্ণ শব্দজাত কানাই শব্দে আজও দন্ত্য ন চলছে, বর্ণ (বর্ণ যোজন) শব্দজাত বানান শব্দে আজও মূর্ধন্য ণ-এর প্রবেশ ঘটে নি তাতে কি পাণ্ডিত্যের খর্বতা ঘটেছে?

 কিছুকাল পূর্বে যখন ভারতশাসনকর্তারা ‘ইণ্টার্ন্’ শুরু করলেন, তখন খবরের কাগজে তাড়াতাড়ি একটা শব্দ সৃষ্টি হয়ে গেল– ‘অন্তরীণ। শব্দসাদৃশ্য ছাড়া এর মধ্যে আর কোনো যুক্তি নেই। বিশেষণে ওটা কী হতে পারে, তাও কেউ ভাবলেন না। Externmentকে কি বলতে হবে ‘বহিরীণ’? অথচ ‘অন্তরায়ণ, অন্তরায়িত, বহিরায়ণ, বহিরায়িত’ ব্যবহার করলে আপত্তির কারণ থাকে না, সকল দিকে সুবিধাও ঘটে।

 নূতন সংঘটিত শব্দের মধ্যে কদর্ষতায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে ‘বাধ্যতামূলক শিক্ষা।’ প্রথমত শিক্ষার মূলের দিকে বাধ্যতা নয়, ওটা শিক্ষার পিঠের দিকে। বিদ্যাদান বা বিদ্যালাভই হচ্ছে শিক্ষার মূলে– তার প্রণালীতেই ‘কম্পাল্শন্’। অথচ ‘অবশ্য-শিক্ষা’ শব্দটা বলবামাত্র বোঝা যায় জিনিসটা কী। ‘দেশে অবশ্যশিক্ষা প্রবর্তন করা উচিত’– কানেও শোনায় ভালো, মনেও প্রবেশ করে সহজে। কম্পালসারি এডুকেশনের বাংলা যদি হয় ‘বাধ্যতামূলক শিক্ষা’, ‘কম্পালসারি সাবজেক্ট’ কি হবে ‘বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয়’? তার চেয়ে ‘অবশ্য-পাঠ্য বিষয়’, কি সংগত ও সহজ শোনায় না? ‘ঐচ্ছিক’ (optional) শব্দটা সংস্কৃতে পেয়েছি, তারি বিপরীতে ‘আবশ্যিক’ শব্দ ব্যবহার চলে কি না, পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করি। ইংরেজিতে যে-সব শব্দ অত্যন্ত সহজ ও নিত্য