পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এই প্রসঙ্গে অবশ্য বাখতিন-বিশেষজ্ঞদের নধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। একটু আগে যাকে কার্নিভালের বিচ্ছুরণ বলেছি, তার পরিধি কতদূর ব্যপ্ত কিংবা কর্তৃত্ববাদ-বিরোধিতাকে কী কী ভাবে ব্যাখ্যাকরা সম্ভব, এ বিষয়ে বিতর্কের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। রাবেলে-পাঠ কি আসলে স্ট্যালিনের জমানায় সরকারি মতবাদের বিরুদ্ধে সুকৌশলে ব্যবহৃত প্রত্যাঘাত? কার্নিভালের হাস্য পরিহাস যেভাবে চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্দেরা দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিল, তেমনি বাখতিনও কি মধ্যযুগীয় সাহিত্যপাঠের অজুহাতে সমসাময়িক স্ট্যালিনপন্থী প্রাতিষ্ঠানিকতাকে বিদ্রূপে বিদ্ধকরার অস্ত্র তুলে দিতে চাইছিলেন সাধারণ মানুষের হাতে? এইসব প্রশ্নও স্পষ্টত সমসাময়িক ইতিহাস নিষ্পন্ন। এটা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রতীচ্য দুনিয়ায় বাখতিন যাদের মধ্যে দিয়ে আবিষ্কৃত ও বিশ্লেষিত হয়েছেন, তারা সাধারণভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরোধী এবং মার্ক্সবাদেরও প্রতিপক্ষ। যেহেতু ইংরেজি-জানা তৃতীয় বিশ্বের কাছে বাখতিন এদের দ্বারাই পরিবেশিত হয়েছেন, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাঁর চিন্তাবিশ্বের ভাষ্যসমূহ গ্রহণ করতে হয় আমাদের। কেননা এইসব ভাষ্যের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদীদের রণকৌশল সম্পৃক্ত সত্যের রাজনীতি।

 উমবের্তো একো ভিন্ন-একটি প্রসঙ্গে আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন অতিভাষ্যের বিপদ সম্পর্কে, সেকথা মনে পড়ে। লোকায়তের প্রতিস্পর্ধাকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করি, এরকম মনে হয় না যে বাখতিন সত্য উচ্চারণের জন্যে কোনো মধ্যযুগীয় সাহিত্যিককে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবেন। সক্রেটিসের দ্বিরালাপ মূলক বাচনিক পদ্ধতিকে যিনি পুনরাবিষ্কার করে মার্ক্সীয় দ্বন্দ্ববাদকেই আরও একটু বিকশিত ও প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন, তিনি কার্নিভালকেও প্রান্তিকায়িত লোকসমাজের নান্দনিক প্রতিরোধমূলক পুনর্নির্মাণের কৃৎকৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অতএব বাখতিনের রাবেলে বিষয়ক বইটিকে পড়তে হবে ‘As a hidden polemic against the regime’s cultural politics’—সাইমন ডেনটিথের এই মন্তব্যে আমাদের সায় নেই। কিংবা হাসি ও কৌতুককর রচনা সামাজিক দ্বন্দ্ব ও আততির সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া রোধ করার একটি কৌশলমাত্র, বলশেভিক বুদ্ধিজীবী লুনাচারস্কির এই ব্যাখ্যা বাখতিনকে কার্নিভালের ধারণা তৈরি করতে কিছুটা প্রভাবিত করেছিল—এই মন্তব্যও সঠিক মনে হয় না। কেননা একটু আগেই আমরা লক্ষ করেছি, গ্রিক শ্রুতিসাহিত্য যখন লিখিত সাহিত্যে রূপান্তরিত হচ্ছিল, সেইসময়কার প্রান্তিক লোকসমাজের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ থেকে সক্রেটিসর দ্বিরালাপ গড়ে উঠেছিল। সঞ্চরমান লোকশ্রুতির বিপুল সমৃদ্ধি থেকে কীভাবে যুগে যুগে গড়ে ওঠে। উচ্চবর্গীয় সাহিত্যিক প্রতিবেদনের বিভিন্ন ধারা—তা বাখতিনের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। রাবেলে-পাঠ এই প্রক্রিয়ারই ফসল।

 ব্যক্তিগত জীবনে যাই ঘটে থাকুক, বাখতিনের মতো মৌলিক চিন্তাবিদ কখনও বিরূপ অভিজ্ঞতার বৌদ্ধিক প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে নিজের মননবিশ্বকে সংগঠিত করেন না। অতএব সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিরক্ত হয়ে ‘inplict rejoinder’ (তদেব) হিসেবে কার্নিভাল প্রণোদিত উদ্ভট বাস্তবতাবাদের বয়ান তৈরি করেছিলেন—এই অভিমত নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়। তাঁর চিন্তাজীবনের প্রধানতম আধেয় ও অবলম্বন যে দ্বিবাচনিকতার দর্শন, তারই প্রেরণায় কর্তৃত্ববাদ ও একবাচনিকতার যথার্থ

৯৬