পাতা:বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী.djvu/১২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।



বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী

শিল্পীর যাত্রাপথের আরম্ভে একটুখানি অথচ অতি ভয়ানক, অতি পুরাতন চোরাবালি। এর মধ্যে একটা চমৎকার, চক্‌চকে সাধুভাষায় যাকে বলে, লোষ্ট্র পড়ে আছে, যার নাম Tradition বা প্রথা। অনন্তকালের সঞ্চিত ধনের মতো এর মোহ; একে অতিক্রম করে যাবার কৌশল জানা হলে তবে শিল্পলোকের হাওয়া এসে মনের পাল ভরে তোলে, ডোববার আর ভয় থাকে না। শিল্পলোকের যাত্রাপথে এই যে একটা মোহপাশ রয়েছে—চিরাগত প্রথার অনুসরণপ্রিয়তা, সেটাকে কাটিয়ে যাবার শিল্প-শাস্ত্র বৈদিক ঋষিরা আমাদের দিয়ে গিয়েছেন—‘মানুষের নির্মিত এই সমস্ত খেলানার সামগ্রী, এই হস্তী, কাংস, বস্ত্র, হিরণ্য, অশ্বতরীযুক্ত রথ প্রভৃতি যে শিল্প সমস্তই দেবশিল্পের অনুকরণমাত্র—একে শিল্প বলা চলে না, এ তো দেব-শিল্পীর দ্বারায় করা হয়ে গেছে, মানুষের কৃতিত্ব এর মধ্যে কোথায়? এ তো শুধু প্রতিকৃতি (নকল) করা হলো মাত্র! হে যজমান শিল্পী, দেব-শিল্পীর পরে এলেম আমরা, সুতরাং আমাদের করাটা নামে মাত্র অনুকৃতি বলে ধরা যায়, কিন্তু আমাদের কাজে সৃষ্টির কৃতিত্ব যেখানে, সেখানে মানুষের শিল্পের সঙ্গে দেবশিল্পের রচনার উপায়ের মধ্যে পার্থক্য কোথাও নেই; শুধু সেটি পরে করা হয়েছে—অনুকৃত হয়েছে মাত্র—এই রহস্য জানো! এ যে জানে সকল শিল্পই তার অধিকারে আসে, শিল্প তার আত্মার সংস্কার সাধন করে, এই যে শিল্প এমন যে শিল্প-শাস্ত্র, কেবল তারি দ্বারায় যজমান নিজের আত্মাকে ছন্দোময় করে যথার্থ যে সংস্কৃতি তাই লাভ করে এবং প্রাণের সঙ্গে বাক্যকে, চক্ষুর সহিত মনকে, শ্রোত্রের সহিত আত্মাকে মিলিত করে।’

 যতদিন মানুষ জানেনি তার নিজের মধ্যে কি চমৎকারিণী শক্তি রয়েছে সৃষ্টি করবার, ততদিন সে তার চারিদিকের অরণ্যানীকে ভয় করে চলছিল, পর্ব্বতশিখরকে ভাবছিলো দুরারোহ, ভীষণ; বিশ্বরাজ্যের উপরে কোনো প্রভুত্বই সে আশা করতে পারছিল না; তার কাছে সমস্তই বিরাট রহস্যের মত ঠেকছিল; সে চুপচাপ বসে ছিল। কিন্তু যেদিন শিল্পকে সে জানলে, সেই মুহূর্ত্তেই তার মন ছন্দোময় বেদময় হয়ে উঠলো, রহস্যের দ্বারে গিয়ে সে ধাক্কা দিলে—সবলে। শুধু এই নয়, ভয় দূরে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মানুষ তার এই দুদিনের