পাতা:বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী.djvu/১৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শিল্পশাস্ত্রের ক্রিয়াকাণ্ড
১৫১

নেই কিন্তু মঞ্জরীর গর্ভে লুকানো রয়েছে সেই পুরাতন বীজ যার মধ্যে সেই একই ক্রিয়া একই শক্তি ধরা রয়েছে নতুন আবহাওয়াতেও যেটা ঠিকঠাক আম গাছই প্রসব করবে বর্ত্তমানকালে; এই স্বাভাবিক গতি ধরে' চলেছে শিল্প, এর উল্টো পাল্টা হবার জো নেই।

 আমাদের দেশের শিল্পমূর্তিকে যে কারণেই হোক এই স্বাভাবিক গতি থেকে বঞ্চিত করে দেওয়া হ’ল এক সময়ে, দেবমূর্তির বাহুল্যের চাপন পেয়ে কিছুদিন গাছ আমাদের মনোমত পথ ধরে' প্রায় কল্পতরু হবার জোগাড় করলে কিন্তু কালের নিয়মে হঠাৎ পশ্চিমের হাওয়া বইলো চাপন পাথর একটুখানি নড়ে' গেল, অমনি গাছ আবার স্বাভাবিক রাস্তা ধরে' মন্দিরের ছাদ তুলসীমঞ্চের গাঁথনি ফাটিয়ে নানাদিকে আলো বাতাস চেয়ে গতিবিধি সুরু করলে, পশ্চিমে ঝুঁকলো কতক ডাল, পূবে বাড়লো কতক ডাল, এইভাবে আলো বাতাসের গতি ধরে' বেড়ে চল্লো গাছ। শুধু ভারতবর্ষ নয়, সব দেশ এই ভাবে শিল্পের দিকে বেড়ে চলেছে। মঞ্চে বাঁধা গাছ দেখতে মন্দ নয় কিন্তু দিকে বিদিকে নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে’ আছে যে বনস্পতি তার মতো সে শক্তিমানও নয় ছায়াশীলও নয় সুন্দরও নয়। আমাদের প্রাচীন শিল্প ও শাস্ত্র সমস্তই বোধিবৃক্ষের কলমের চারার সঙ্গে সোনার গামলায় নীত হয়েছিল দেশ থেকে বিদেশে, কিন্তু সেই সব যবন-দেশের হাওয়া আলো নিয়ে তাদের বেড়ে উঠতে অনেকখানি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, ভিক্ষু শিল্পীদের দ্বারা তাদের সহজগতি ব্যাহত হয়নি; তবেই তো এককালের ভারতীয় উপনিবেশের অভারতীয় অন্তরের মধ্যে চলে গিয়েছিল ভারতীয় ভাব ও রস। ভারত শিল্প যদি কেবলি টবের গাছ হ’ত তো কোন কালে সেটা মরে যেত ঠিক নেই, খালি টব থাকতো আর তাতে সিঁদূর দিয়ে পুজো লাগাতো দেখতেম আজও পুত্র-কামনায় নিষ্ক্রিয়দেশের শিল্পহীন অপুত্রক হতভাগারা।

 সেকালের শাস্ত্রমতে ক্রিয়া করে' চল্লে এখনো আমরা সেকালের মতোই সবদিকে বিস্তার লাভ করতে পারি, কিন্তু একালকে বাদ দিয়ে ক্রিয়া করা চলবে না কেননা বর্তমানকাল এবং বর্তমানের উপযোগী অনুপযোগী ক্রিয়া বলে' কতকগুলো পদার্থ রয়েছে যে গুলোকে মেনে চলতেই হবে আমাদের, না হ’লে সেকালটা ভূতের উপদ্রব ছাড়া আর কিছুই দেবে না আমাদের এবং তাবৎ শিল্পজগতের অধিবাসীকে।