ফারসী, তুর্কী ইত্যাদি শব্দের বহুল মিশ্রণ হইলেও যে তাহা আরবী, ফার্সী বা তুর্কী হইয়া উঠিবে না এবং বাঙ্গালীর মাতৃভাষায় ইংরেজী, পর্ত্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসী ইত্যাদি শব্দ ও বৈদেশিক বাগ্ধারা এবং ভাবানুবাদ যদৃচ্ছাক্রমে মিশ্রিত করিলেও তাহা ফার্সীতে বা যুরোপীয় কোন ভাষাতেই পরিণত হইবে না, অথচ বিশুদ্ধ উচ্চ বাঙ্গালাও থাকিবে না, তাহা স্বীকার করিতেই হইবে। অবঙ্গীয় যে-কোন ভাষার শব্দ যতদিন বঙ্গীভূত বা বঙ্গসন্তানগণের মাতৃভাষার অঙ্গীভূত ও বাঙ্গালার নিজস্ব বলিয়া পরিগণিত না হয়, ততদিন তাহা বাঙ্গালা বলিয়া স্বীকৃতই হয় না। যে গুলি তাহা এখনও হয় নাই, অথচ লেখকের সংস্কার ও রুচি অনুসারে ব্যবহৃত হইয়া বিশুদ্ধ বাঙ্গালার স্বরূপ পরিবর্ত্তিত ও সাহিত্য বিকৃত করিবে, তাহাও ভবিষ্যৎ বাঙ্গালা বৈয়াকরণ ও আভিধানিকের নির্ণয়স্থল এবং আলোচনা ও সমালোচনার ক্ষেত্র হইয়া থাকিবে। যুরোপীয় সাহিত্যে প্রয়োজনবশে ব্যবহৃত ভাষান্তরের শব্দ, বাক্যাংশ, প্রবাদ ইত্যাদি উদ্ধার চিহ্নের (“”) বন্ধনী মধ্যে ভিন্ন টাইপে মুদ্রিত হইয়া থাকে। সভ্য জগতের বর্ত্তমান সংস্কৃতি ও প্রগতির আবহাওয়ায় আন্তর্জ্জাতিক মেলামেশা বা আদান-প্রদানের ফলে, বাঙ্গালী ভাষার ন্যায় অতি প্রাচীন ও জীবন্ত ভাষায় বিশুদ্ধ সংস্কৃত-ব্যাকরণানুগত্য, সংস্কৃত কোষ-সম্মত শব্দশুদ্ধি ও ভাষাশুদ্ধি-প্রিয়তা বঙ্গের কৃষ্ণযুগসুলভ উৎকট সংস্কৃতশরণ পণ্ডিতী কুসংস্কারের ফল অথবা পণ্ডিতী শুচি-বাই ব্যতীত আর কি বলা যাইতে পারে? সুশিক্ষিত সভ্যজাতি কত যুগযুগান্তরের শিক্ষা ও সংস্কারের মধ্য দিয়া আসিয়া বর্ত্তমান অবস্থায় পৌঁছিয়াছে তাহার কাল নির্ণয় করা শুধুই অসাধ্য নহে, তাহা ধারাবাহিক ইতিহাস অভাবে অসম্ভবও বটে, কত অসভ্য ও অর্দ্ধসভ্য জাতি স্বীয় আদিম মাতৃভাষার শব্দ ও শব্দের রূপান্তর বর্ত্তমান ভাষার মধ্যে ডুবাইয়া দিয়া ধরাপৃষ্ট হইতে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে তাহার শব্দতাত্ত্বিক ইতিবৃত্ত নাই। কোল, মোঙ্গোল, দ্রাবিড় ইত্যাদি ভাষার শব্দসম্বন্ধেও সেই একই কথা। কোচজাতির বিলুপ্ত শাখা অন্বেষণ করিতে হইলে বর্ত্তমান কাছারীদিগের জাতীয় ইতিহাস উদ্ঘাটন করিতে হয়। কারণ কাছারীদের কথ্যভাষা সেই বিলুপ্ত কোচ ভাষার নিকট বহুলাংশে ঋণী, কিন্তু কতটা তাহার নির্ণয় নাই। মানুষের জন্ম হইতে বার্দ্ধক্যে মৃত্যু পর্য্যন্ত প্রতিদিনের আলোকচিত্র তুলিয়া প্রাশাপাশি সাজাইয়া রাখিলে জন্মকালীন মূর্ত্তির সহিত তাহার বার্দ্ধক্যে মৃত্যুকালীন মূর্ত্তির প্রভেদ অনুমেয়। সেই একই ব্যক্তির অগ্রপশ্চাৎ অবস্থার মূর্ত্তিভেদ অর্থাৎ যৌবনের সঙ্গে শৈশবের, প্রৌঢ়ত্বের বা বার্দ্ধক্যের যে প্রভেদ ও ক্রমপরিবর্ত্তন লক্ষিত হয়, সেই রূপান্তর জীবন্ত ভাষা ও সাহিত্যের ভিন্ন ভিন্ন স্তর-ভেদের মধ্য দিয়াও সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। ভাষার নিখুঁত ইতিহাস না থাকায়, স্বকীয় জ্ঞান, বুদ্ধি বিদ্যার ও পূর্ব্বজ্ঞান বা বহুদৰ্শনের সহিত ব্যক্তিগত কল্পনাকে অবলম্বন করিয়া শব্দের মূল, ব্যুৎপত্তি, ক্রমপরিবর্ত্তন, বিকৃতি ও ভাষার প্রকৃতি বহুলাংশে অনুমান করিয়া ভাষার ইতিহাস গড়িয়া তোলা হয় মাত্র। ফলে তাহা অল্পাধিক প্রকৃত ও অপ্রকৃত হইয়া দাঁড়ায়। সাধারণতঃ
পাতা:বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রথম ভাগ.djvu/১০
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৬
ভূমিকা