তথ্যগুলির অধিকাংশ ভাগ তথ্যই সম্প্রদায়ের গ্রাহ্য হইলেই ইতিহাসের সার্থকতা স্বীকৃত হয়। এই হিসাবে জগতের কোন্ জাতির মাতৃভাষা অমাতৃভাষিক শব্দমিশ্রণে মিশ্রভাষাগন্ধি হইয়াও স্বাজাত্য রক্ষাহেতু খাঁটি মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকৃত না হয়?[১]
অভিধান প্রণয়নে সঙ্কলনকারের কর্ত্তব্যপথে একটি সমস্যা প্রথমেই দেখা দেয়; তাহা এই যে, স্বকীয় আদর্শের সহিত অন্যের আদর্শের সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া অভিধানকে কিরূপে জাতীয় অথচ অসাম্প্রদায়িক করা যায়। আমরা যে, অভিধানকে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর করিয়া তুলিতে পারি না, তাহার জন্য আদর্শ-বিশেষের দোহাই দিয়া স্বীয় অক্ষমতা এবং অজ্ঞতা ঢাকা দেওয়া চলে না। ভাষার প্রাচীনতম কাল হইতে বর্ত্তমান পরিণতির ধারাবাহিকতার ক্ষুণ্ণতা, উপকরণের অপ্রাচুর্য্য, আভিধানিকের সীমাবদ্ধ আয়ু, জ্ঞান, প্রবৃত্তি ও কর্ম্মশক্তি এবং প্রয়োজনমত প্রচেষ্টা, অর্থবল ও সঙ্ঘশক্তিনিয়োগের সুবিধার অভাবই প্রধাণতঃ তাহার কারণ বলিয়া স্বীকার্য্য।
শব্দের বানান লইয়া বহু বিতর্ক। একই শব্দের বিকল্পবিধানে বানানের রূপান্তর। ‘ ি, ী, ু, ূ, ণ, ন, য, জ, বর্গীয় ও অন্তস্থ ব, শ, ষ, স’-এর পরিবর্ত্ত এবং কোন্ মত গ্রাহ্য, তাহা লইয়াও মতভেদ। এক পক্ষে যাহা সংস্কৃত-ব্যাকরণ-সম্মত তাহাই সাধু, আর্ষ-প্রয়োগ-বিশুদ্ধ বা অতিব্যবহারে অপরিহার্য্য এবং যাহার বাহিরে সমস্তই অপভ্রষ্ট, অপাঙ্ক্তেয় ও সমর্থনের অযোগ্য এরূপ শুচিবাদিতা বা অতিনৈষ্টিকতা রচনারীতির দিক্ দিয়া অবলম্বনীয় বিবেচিত হয়। পক্ষান্তরে, ক্রমবিকাশশীল জীবন্তভাষা যাহা পুরাতন ও বর্ত্তমান অতিক্রম করিয়া উদ্দাম গতিতে অগ্রসর হইতেছে ও যাহা একমাত্র অনুশাসক সঙ্ঘ, শক্তিমান্ সমালোচক ও সাহিত্য গুরুগণের প্রভাবে কথঞ্চিৎ সংযত হইতে পারে, তাহাও আভিধানিকের লক্ষ্যের বহির্ভূত নহে। অধুনা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক বানান-সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলিতেছে এবং বাঙ্গালা বানানের নির্দ্দিষ্ট ধারা লিপিবদ্ধ করা হইতেছে। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক নিযুক্ত “বাঙ্গালা বানানের নিয়ম-সংকলক-সমিতি” বহু বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপকের পরামর্শ গ্রহণ করিয়া ও পরে, বহু অভিজ্ঞের সমর্থন, প্রতিবাদ, আলোচনা ও সমালোচনা বিচারপূর্ব্বক নিয়মাবলীর সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণও প্রচার করিয়াছিলেন। তাহারও পরবর্ত্তী মতানৈক্য বিচারান্তে যে পুনঃসংশোধিত তৃতীয় সংস্করণ, যাহা বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক গৃহীত ও প্রচারিত হইয়াছে, তাহা ভাষার বর্ত্তমান প্রগতি, কালানুযায়ী পরিণতি ও নিয়মাবলীর পুনঃ বা পৌনঃপুনিক, সংস্করণ-সম্ভাবনার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া বিশ্ববিদ্যালয়-গ্রাহ্য ভবিষ্যৎ পাঠ্য-পুস্তক-লেখকগণের পথ-প্রদর্শক স্বরূপ ও ভবিষ্য ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞাতব্যবোধে অভিধানের পরিশিষ্ট-ভাগে সন্নিবেশিত হইল। বানানের এই নিয়ম সাহিত্যরথিগণ এবং তাঁহাদের অনুগামী লেখকগণ কর্ত্তৃক অনুসৃত হইতে থাকিলে, সেই অত্যাধুনিক বানান ভবিষ্যৎ বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও অভিধানের অবলম্বনীয় হইতে পারে।
- ↑ “There is hardly a language that in some sense may not be called a mixed language. No nation or tribe was ever so completely isolated as not to admit a certain number of foreign words.”—Max Müller.