পাতা:বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রথম ভাগ.djvu/৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করার সময় সমস্যা ছিল।
ভূমিকা

পুরাতন ও নূতনের সংমিশ্রণ, দুষ্পাঠ্য এবং আন্তর্জ্জাতিক আদান-প্রদানের ফলে অদ্যাবধি ভাষার যে পরিবর্ত্তন ও শব্দ-সম্পদের বৃদ্ধি পরে পরে সাধিত ও স্তরে স্তরে সঞ্চিত হইয়াছে, তাহার যুগবিশেষের লক্ষণ ধরিয়া সমগ্র ভাষার প্রকৃতি নির্ণয় করাও যেমন যুক্তিসঙ্গত হয় না, তদ্রূপ বাঙ্গালা শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ের জন্য সংস্কৃত-ব্যাকরণানুমোদিত গঠন-ধারাই একমাত্র অবলম্বনীয় হইতে পারে না। বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের রেনেসাঁস্ (Renaissance) অর্থাৎ নবজাগরণের বর্ত্তমান যুগে যে বৈচিত্র ও বৈষম্য দেখা দিতেছে, তাহার অদম্য প্রগতি-মুখে শব্দাদির ব্যুৎপত্তিনির্ণায়ক বিভিন্ন মতের সমন্বয় সাধন করিয়া বানান ও রূপনিয়মন, শব্দের বিশুদ্ধি-নির্দ্ধারণ এবং মাতৃভাষার নিজত্ব-সংরক্ষণ বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও অভিধানকারের সম্মুখে কঠিন সমস্যাস্বরূপ দেখা দিয়াছে। ভাষার দ্রুত পরিবর্ত্তনশীলতার প্রতি লক্ষ্য করিলে এবং পূর্ব্বাপর ইতিহাস অনুসন্ধান করিলে ইহাই মনে হয় যে, পূর্ব্ব পূর্ব্ব বাঙ্গালা-অভিধানকারদিগের সংস্কৃত-শব্দমাত্রেরই ব্যুৎপত্তিনির্ণয়ে প্রবৃত্তি এবং সংস্কৃতেতর শব্দের ব্যুৎপত্তি-নির্ণয়ের মূলে অপ্রবৃত্তিই বিদ্যমান ছিল। আধুনিক যুগে সেই পুরাতন প্রথার ক্রমে ক্রমে অবসান হইয়া আসিতেছে এবং সংস্কৃত তৎসম, ও তদ্ভব শব্দ ব্যতীত শব্দের “যাবনিক,” “বৈদেশিক,” “দেশজ”, “অনার্য্য” ইত্যাদিরূপ অনির্দ্দিষ্ট-ইঙ্গিত প্রকটন-প্রথার পরিবর্ত্তে প্রত্যেক শব্দের স্ব স্ব ব্যুৎপত্তি বা মূলের এবং অবঙ্গীয় শব্দ বঙ্গীয়ভূত হইবার কাল, ক্রম, পরিবর্ত্তন ও পরিণতি-প্রাপ্তির ইঙ্গিত বা উল্লেখমাত্র করিয়া ক্ষান্ত হইবার লক্ষণ দেখা দিতেছে। সংস্কৃত “শন্ট” শব্দের “শন্” ধাতু-অর্থে, “দান করা, গতি করা”। তাহাতে কর্ত্তৃবাচ্যে “ট” প্রত্যয় যোগে শন্ট শব্দ নিষ্পন্ন হয়। সুতরাং এই শব্দের ধাতুগত অর্থ হইতেছে—যে দেয় বা দান করে অর্থাৎ দাতা বা যে গতি বা গমন করে অর্থাৎ যে যায় বা গতিকারক। অভিধানে এই এই ব্যুৎপত্তি নিষ্পন্ন “শন্ট” শব্দের পুংলিঙ্গার্থে “ষাঁড়” (বলদ নহে) এবং ক্লীবলিঙ্গার্থে “খোজা” বা “নপুংসক” (নর বা নারী নহে) এই কষ্টকল্পিত অর্থ পাওয়া যায়। উক্ত কষ্টকল্পনামূলক ব্যুৎপত্তি সংস্কৃত-ব্যাকরণ-সিদ্ধ হইলেও এরূপ শব্দগঠন-নির্ণয়ের সার্থকতা কিরূপে স্বীকৃত হইতে পারে? এবং ভাষাতত্ত্বেরই বা কোন্ নীতি-সঙ্গত হয়? সুতরাং “কলে-ফেলা”-প্রথাগত ব্যুৎপত্তি না দেখাইয়া “[সং]” অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ বা তাহা হইতে আগত এইরূপ ইঙ্গিতমাত্র করাই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়।

 বাঙ্গালা ভাষার রূপ দান করিতে সংস্কৃত বা প্রাকৃতের যতই প্রভাব বা কৃতিত্ব থাকুক না কেন, অথবা সংস্কৃতভাষা বাঙ্গালা ভাষার ধাত্রী বা মাতৃস্থানীয়া অথবা, বাঙ্গালা সংস্কৃতের দৌহিত্রী-স্থানীয়া বিবেচিত ও স্পষ্ট প্রমাণীত হউক না কেন, বাঙ্গালা বা হিন্দী যে সংস্কৃত নহে, তাহা স্বীকার্য্য; ইংরেজী অধিকাংশভাগ লাতিনপ্রভব এবং বহুভাষার শব্দসংহতিমূলক হইলেও ইংরেজী ভাষা যে কোন অবস্থাতেই লাতিন, জর্ম্মন, ফ্রেঞ্চ্, ইত্যাদি কোন নামেই অভিহিত হইতে পারেনা, অর্থাৎ তাহা ইংরেজী ব্যতীত আর কোন ভাষাই নহে। উর্দ্দু বা হিন্দীর ভূমিতে আরবী,