ভূমিকা।
সম্পাদন সম্ভব হইতে পারে, সে অবস্থায় পৌঁছিতে আমাদের এখনও বিলম্ব আছে। সাহিত্যে প্রবিষ্ট শব্দারণ্যে কথ্য-ভাষায় সহস্ৰ সহস্র গ্রাম্য শব্দ এবং তাহদের উচ্চারণ-বিকার ও ব্যবহার-বৈষম্যজনিত অসংখ্য প্রাদেশিক রূপান্তর মিলিত হইয়া অভিধান-সঙ্কলয়িতার কৰ্ম্মক্ষেত্র কণ্টকিত করিয়া রাখিয়ছে। ভাষার অভিধানে কোন গুলি গ্রহণযোগ্য এবং কোন গুলি বর্জ্জনীয় প্রথমতঃ তাহাই এক বিষম সমস্যা! বাঙ্গালা বৈষ্ণবপদাবলী-সাহিত্য মৈথিল শব্দে (ব্রজবুলিতে) আকণ্ঠ চুবিয়া আছে। কয়েক শতাব্দীর মুসলমান শাসন মধ্যবাঙ্গালা ভাষাকে আরবী ও ফারসী শব্দবহুল করিয়া ফেলিয়াছে। আদালতের ভাষা ও মুসলমানী বাঙ্গালা তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যুরোপীয় সংস্রব বর্তমান বাঙ্গালীকে কিরূপ যুগোচিত ছাচে ঢালিতেছে, ৺চন্দ্রনাথ বসু মহাশয় ১৮ বৎসর পূর্বে তাহার আলোচনা করিয়া গিয়াছেন। বৈদেশিক শব্দ ব্যতীত বাঙ্গালা সাহিত্যে এত অধিক গ্রাম্য শব্দ প্রাচীন এবং বর্তমান শ্রেষ্ঠ লেখকগণ কর্তৃক ব্যবহৃত হইয়াছে যে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও বৈদেশিক শব্দ সমূহের মধ্যে ঐ গুলিকেই খাঁটি বাঙ্গালা শব্দ বলিবেন কি না তদ্বিষয়ে অনেকের সন্দেহ জন্মিতেছে। সাধারণ ও স্বাভাবিক নিয়মে যে কোন শব্দই হউক, কোন ভাষায় ব্যবহারের প্রাচীনতা এবং ভুরি প্রচলনের দ্বারা সেই ভাষার খাঁটি শব্দে পরিণত হইতে পারে। হোরা, পিক, তামরসাদি যে মেচ্ছ ভাষার শব্দ তাহা পণ্ডিত কালীবর বেদান্তবাগীশ মহাশয় বিশেষভাবেই প্রদর্শন করিয়াছেন। ঐ সকল শব্দ বাঙ্গালা ভাষাতেও বহু প্রচলিত। কিন্তু এগুলি খাঁটি সংস্কৃত শব্দ নহে সুতরাং অপাঙ্ক্তেয় বলিয়া খাঁটি সংস্কৃত অভিধান হইতে কি কেহ বর্জ্জন করিয়াছিলেন অথবা এখন কেহ তাহা সংস্কৃত বা বাঙ্গালা অভিধান হইতে বিসর্জ্জন করিতে পারেন? খাঁটি বাঙ্গালা শব্দাভিধান হইতে যদি বিশুদ্ধ সংস্কৃত ও বৈদেশিক শব্দসমূহ বর্জ্জন করা যায়, যদি অমিয়া, পঁহু, আইন, কানুন, সাবান, ফিতা, রসদ, রসীদ, টেবিল, চেয়ার, পাউরুটী, রেস্ত, বোতাম, বোতল, গেলাস, ডিশ্, স্কুল, কলেজ প্রভৃতি যে সকল শব্দ ভিন্ন ভিন্ন যুগের বাঙ্গালা সাহিত্যকে পরিপুষ্ট করিয়া ভাষার অস্থিমজ্জাগত হইয়া পড়িয়াছে, সে সমস্ত বাদ দেওয়া যায়, তাহা হইলে, কেবল খুদ কুঁড়ো, টেঁকী, কুলা আর গো-ডিম শ্রেণীর শব্দ লইয়া—থোড় বড়ি আর খাড়া লইয়া খাঁটি বাঙ্গালা অভিধান খাড়া করিতে হয়। সুতরাং বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দই কি, বিশুদ্ধ বৈদেশিক শব্দই কি, আর দেশীয় অনান্য শব্দই কি—যাহা ভাষায় প্রচলিত আছে তাহা ভাষার অভিধানে স্থান পাইবার যোগ্য। এতদনুসারে বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে সেই সকল শব্দ গৃহীত হইয়াছে; কিন্তু পয়োর, এধিত, মিথঃ, নন্দধু, কিমুত, রাহ প্রভৃতি সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত বা সংস্কৃত অভিধানের অন্তর্ভুক্ত শব্দ, যাহার ব্যবহার বাঙ্গালা কথ্য বা লিখিত ভাষায় নাই এবং কখনও যে ব্যবহারে আসিবে তাহার সম্ভাবনা অল্প—যাহাদের স্থান প্রয়োজনীয় শব্দে পূর্ণ হইতে পারে, তৎসমুদয় বর্জ্জিত হইয়াছে, অথচ যে-গুলির প্রচলন না থাকিলেও, ব্যবহারে ভাষার সৌন্দৰ্ঘ্য ও ভাবের গাম্ভাৰ্য্য বৃদ্ধি পাইতে পারে, সেরূপ বহুশব্দ গৃহীত হইয়াছে। শিল্পবিজ্ঞান, রসায়ন, দর্শন, স্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থে ব্যবহৃত এবং বিজ্ঞানাচাৰ্য্য পণ্ডিত রামেন্দসুন্দর ত্ৰিবেদী, ডাক্তার প্রফুল্লচন্দ্র রায়-প্রমুখ বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক উদ্ভাবিত বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদের সুধীবৃন্দ কর্তৃক আলোচিত বহু পরিভাষিক শব্দও ইহার অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে। ইংরেজীতে যেসকল শব্দ প্রাকৃত-জনোচিত (vulgar বা slang), কথ্য (colloquial) ও প্রাদেশিক (provincial) বলিয়া বিশেষিত, তাহা গ্রাম্য-পর্য্যায়ভূক্ত। জীবিত ভাষায় ইহার বাহুল্য