বাঙ্গালার এমনও দিন গিয়াছে, যখন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতগণ অমরকোষাদি সংস্কৃত অভিধানের শব্দসমূহ বিভক্তিযুক্ত অথবা বিভক্তিহীন করিয়া বঙ্গীয় পদ্ধতি-সিদ্ধ ক্রিয়াযোগে সম্পূর্ণ সংস্কৃত ব্যাকরণের ছাঁচে-ঢালা পণ্ডিতী বাঙ্গালার সৃষ্টি করিতেছিলেন; যখন বৌদ্ধ-বাঙ্গালা চাপা পড়িয়া গিয়াছিল, বৈষ্ণব-বাঙ্গালা সম্প্রদায়গত ছিল, অপণ্ডিতের ভাষা পণ্ডিত-সমাজে অবজ্ঞাত হইয়াছিল এবং নব্য ইংরেজীশিক্ষিত সভ্যমহলে কথ্য-বাঙ্গালা অকথ্য হইয়া উঠিতেছিল। সেই সময়ের বাঙ্গালা অভিধানগুলিকে সংস্কৃত-বাঙ্গালা অভিধান বলা যাইতে পারে। তাহার পরবর্ত্তী কালেও গতানুগতিকভাবে বাঙ্গালা অভিধানকারকগণ সাহিত্যে প্রবিষ্ট অসংস্কৃত শব্দগুলিকে অতি সন্তর্পণে বর্জ্জন করিয়া অভিধানের বিশুদ্ধি ও মর্যাদা রক্ষা করিয়া গিয়াছেন। ইতিপূর্ব্বে দুই একখানি বাঙ্গালা অভিধান এই প্রথার অন্যথাচরণ করিলেও, এখনও সে চেষ্টা এককালে পরিত্যক্ত হয় নাই। বাঙ্গালা অভিধান কিন্তু, অভিধান সঙ্কলনের পূর্ববপদ্ধতি বজায় থাকা সত্ত্বেও, কাল প্রভাবে, এখন বাঙ্গালানামধেয় সংস্কৃত-বাঙ্গলা পুরাতন অভিধানের নুতন সংস্করণে মধ্যে মধ্যে বাঙ্গালা গ্রন্থ হইতে উদ্ধার এবং সংস্কৃতের অপভ্রষ্ট ও অবঙ্গীয় শব্দও যুক্ত করিতে হইতেছে। সাহিত্যে টেকচাঁদ ঠাকুর যেমন অসীম সাহসে আলালী ভাষার প্রবর্ত্তন করিয়া যুগান্তর আনিয়াছিলেন, বঙ্গীয় শব্দসিন্ধুকার শ্রীযুক্ত রজনীকান্ত বিদ্যাবিনোদ মহাশয়ের পর, পাণ্ডিত্যে লব্ধপ্রতিষ্ঠ অধ্যাপক শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় তেমনি অসীম সাহসে তাঁহার বাঙ্গালা ব্যাকরণ প্রণয়ন ও বাঙ্গালা শব্দকোষ সঙ্কলন করিয়া বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও অভিধানের ইতিহাসে যুগান্তর আনয়ন করিয়াছেন। কিন্তু পূর্ব্ব পূর্ব্ব অভিধানকারগণ যেমন বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য হইতে বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দগুলি বাছিয়া বাছিয়া অভিধানের অন্তর্ভুক্ত করিয়াছেন, বিদ্যানিধি মহাশয় তদ্রূপ একটা মূল উদ্দেশ্য ধরিয়াই তাহার অভিধান হইতে সেইগুলিকে বিসর্জ্জন করিয়াছেন। তথাপি তাঁহার শব্দকোষ পরবর্তী অভিধানসঙ্কলয়িতাগণের কর্ম্মক্ষেত্র সুগম করিয়া দিয়াছে এবং তিনি তাঁহাদের ও সাধারণের কৃতজ্ঞতাভাজন ও ধন্যবাদার্হ হইয়াছেন। বর্ত্তমান অভিধানের উদেশ্য স্বতন্ত্র, সুতরাং প্রণালীও ভিন্ন। এলাহাবাদ অবস্থানকালে পঞ্চদশবর্ষ পূর্ব্বে “বঙ্গভাষা ও বাঙ্গালী অভিধান” এবং “বাঙ্গাল শব্দতর” প্রবন্ধে “প্রবাসী” ও “সাহিত্যপরিষৎ-পত্রিকায়" অভিধান সঙ্কলনের প্রণালী সম্বন্ধে যে আভাস দিয়ছিলাম বর্ত্তমান “বাঙ্গলা ভাষার অভিধানে” প্রধানতঃ তাহারই অমুসরণ করিয়াছি। ভাষা-বৈজ্ঞানিকের সিদ্ধান্তমতে মাগধী-প্রাকৃতই প্রাচীনতম বাঙ্গালার মূল। কিন্তু কি প্রাচীন কি বর্ত্তমান সকল অবস্থাতেই সংস্কৃতের প্রভাব অল্পাধিক বিদ্যমান আছে। প্রাচীন বাঙ্গালা যুগ-প্রভাবের অধীন হইয় পূর্ব্বরূপ অল্পধিক পরিবত্তন এবং হিন্দী, গুজরাতী প্রভৃতি সংস্কৃত-প্রাকৃত মূলত, দ্রাবিড়, আরবী, ফ়ারসী, পর্ত্তুগীজ্ ও ইংরেজী প্রভৃতি ভাষার শব্দ ও তার গ্রহণ করিতে করিতে বর্তমান রূপে পরিণত হইয়াছে। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়-সম্পাদিত বৌদ্ধবাঙ্গালা তান্ত্রিক