পাতা:বিচিত্র জগৎ - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক গ্রীস ܘܬ আর্জেন্টিনা দেশের দিকে আণ্ডিজের পাদমূলে মেণ্ডোজ সহরে আরোহীর বড় রেলপথ ছেড়ে মরুপাৰ্ব্বত্য রেল-লাইনের গাড়ীতে চড়ে । কয়েক ঘণ্টা ধরে গাড়ী যায় আণ্ডিজের নীচের অংশ দিয়ে—যত ওপরে উঠতে থাকে, তত ইঞ্জিনের গতি ক্রমশঃ মন্দীভূত হয়, রেলের লাইনের সেখানে খাজ-কাটা, রেলপথের খাড়াই সেখানে ক্রমশঃ বাড়ে, টানেল দীর্ঘতর হয় এবং সংখ্যাতেও বৃদ্ধি পায়, উদ্ভিদরাজি অদৃশ্য হয়। জুল বা জুলাই মাসে এই রেলপথে ভ্ৰমণ করলে আণ্ডিজ পৰ্ব্বতের পরিপূর্ণ মহিমা ও তুষারাবৃত রুক্ষরূপের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। তখন এমন একটা কিছু দেখা যায়, জীবনে যা আর কখনো দেখা হয় নি। এর কারণ জুন বা জুলাই মাস দক্ষিণ আমেরিকার শীতকাল, আণ্ডিজের উচ্চতর অঞ্চলের তুষার ঝটিকা, বরফপাত, কুয়াসাবৃত শিখররাজির রূপ এই সময়ে যা দেখা যায় এবং যত আরামের সঙ্গে গদী-আঁটা আসনে বসে দেখা যায়-পৃথিবীর কোন উচ্চ পর্বতমালায় এ শীতের রূপ তত আরামে দেখা যায় না। অনেক সময় তুষাররাশি সরিয়ে ফেলবার কল এঞ্জিনের আগে আগে যায়। ১৯৩০ সালে রেলপথের ওপর ২৫ ফাঁট পুরু হয়ে তুষার পড়েছিল, দুদিকের ট্ৰেণ আরোহীসমেত কয়েকদিন ধরে মাঝপথে আটকে গিয়েছিল । ক্রমশঃ ওপরের দিকে উঠতে উঠতে রেলপথ মাউণ্ট টুপুন গাতোর (২১,৫৫০ ফুট ) পাদদেশ দিয়ে চিলির দিকে গিয়েছে।-নিকটেই একটা অস্তৃত-গঠনের পর্বতশৃঙ্গ, দেখতে ঠিক যেন ধূসর বর্ণের আলাপোল্লা-পরা খৃষ্টান সন্ন্যাসী । মাউণ্ট টুপুন গাতোর ঘন ছায়া ছাড়িয়ে আবার সূৰ্য্যালোকে নিস্ত্রাপ্ত হওয়ার কিছু পরেই ট্রেন “পুয়েণ্টে ডেল ইস্ক’ ব’লে একটা প্ৰকৃতির নিৰ্ম্মিত পাথরের সেতু পার হয়,-দিন পরিষ্কার থাকলে এই সেতু পার হবার সময়ে আরোহীরা দক্ষিণ দিকে চেয়ে বিশাল অ্যাকনাকাওয়া পৰ্ব্বতের মহিমময় দৃশ্য দেখতে পাবে-সমগ্ৰ আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে অ্যাকনুকাওয়া সৰ্বোচ্চ পৰ্ব্বত তার চিরতুষারাবৃত শিখর সমুদ্রবক্ষ থেকে ২৩,০৮৭ ফকীট উদ্ধে আকাশকে স্পর্শ করেছে। পশ্চিমমুখী ট্রেন লাস কুয়েভাসে চিলির সীমান্তে পৌছে যায়। এখান থেকে ওপর দিকে চেয়ে দেখলে পাহাড়ের ওপর দিকে টেলিফোন লাইন দেখা যাবে-এবং যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে। তবে লাস কুয়েভাস ষ্টেশনে পৌছবার ঠিক আগে, যেমন দু মাইল দীর্ঘ টানেল পার হয়ে টেন রৌদ্রালোকিত চিলি স্পর্শ করবে, ঠিক সেই সময় পাহাড়ের ওপরের দিকে চাইলে টেলিফোন লাইনেরও অনেক ওপরে চিলি ও আর্জেন্টিনা এ দুই দেশের আন্তর্জাতিক শান্তির প্রতীকস্বরূপ স্থাপিত জগৎবিখ্যাত শাস্তি-স্তম্ভ ‘ক্ৰাইষ্ট অফ দি আণ্ডিজ চিলি আর্জেন্টিনা-সীমান্ত সমুদ্রবক্ষ থেকে ১২,০০০ কীট উঁচু একটা পৰ্ব্বতের ওপর দেখা যাবে। ; : অনেক নীচে দেখা যাবে পর্বতশৃঙ্গবেষ্টিত ইঙ্কাইদ-সেও সমুদ্রবক্ষ থেকে ৯০০০ কীট, উচ্চে। এখান থেকে ট্রেন-বড় বড় টানেলের মধ্য দিয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে, দুধারে খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল, তাদের সৌন্দৰ্য্য ও মহিমা অবর্ণনীয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিরাপদ, স্ট্রাম দ্বারা উত্তপ্ত টেনের কামরায় বসে আরোহীরা তাসের টেবিল থেকে মুখ তুলে দেখতে পাবে ধীশুখৃষ্টের শান্তমূৰ্ত্তি তুষারাচ্ছন্ন পৰ্বতমালার পটভূমিতে তখনও অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। উচ্চতর গিরিপথের স্বর তাদের কানে যাধে-তুষারপাতের শব্দ, পাহাড়ের চুড়ার মধ্যে ঝড়ের গর্জন ধ্বস নামার গুরুগম্ভীর রব। তাস খেলতে খেলতে একজন প্রথমশ্রেণীর সেলুনের যাত্রী বাইরের দিকে চেয়ে বললেন, অনেক উঁচু দিয়ে ওটা কি চলে গিয়েছে সাদা দড়ির মত ? কেউ উত্তর দিলে না । তাদের মধ্যে অনেকেই জানে না। ওটা পৃথিবীর সর্বোচ্চ টেলিফোন লাইন, সান্তিয়াগোর হোটেলে বসে। তুষারাচ্ছন্ন আণ্ডিজ, সুন্দর পাম্পাস প্রান্তর, সমুদ্র, অরণ্যানীর ব্যবধান এড়িয়ে যে কেউ স্বচ্ছন্দে ইউরোপ বা যুক্ত রাজ্যের কোনো বন্ধুর সঙ্গে খোসগল্প করতে পারে যে কোনো সময়। প্ৰাচীন দিনের ইঙ্ক-বীর তুপাক উপাঙ্কি যেদিন তার বিজয়ী সৈন্যবাহিনী আণ্ডিজের বিপদসঙ্কুল গিরিপথের ওপর দিয়ে আর্জেণ্টাইনের দিকে পরিচালিত করেছিলেনকত দূরের হয়ে গিয়েছে সে সব দিন। আজ সান্তিয়াগোতে বসে প্ৰণয়ী প্যারিসের প্রণয়িনীকে বলছে-কেমন আছ বন্ধু ? প্ৰণয়িনী হেসে বলছেভাল আছি, প্ৰিয়তম । গভীর পাহাড়ের খডের এ পারে দাড়িয়ে জেনারেল সান মার্টিন, ওপারে বৃদ্ধ ইন্ধাবীর তুপাক উপাঙ্কি দুজনে কি কথাবাৰ্ত্তী কইছেন উচ্চৈঃস্বরে, তুষার ঝটিকার গর্জনে কেউ কারোর কথা শুনতে পাচ্ছেন না। R