পাতা:বিচিত্র জগৎ - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হাওয়াই হইতে স্যানফ্রান্সিসকো ৬৯ আমি সামনে চেয়ে ভাবছি, যেখােন পৰ্য্যস্ত ছুটে গিয়ে এরোপ্লেনের মাটী ছেড়ে আকাশে উঠবার কথা, সেখাণে গিয়েও যদি এরোপ্লেন না। ওঠে, তবে মোটর থামিয়ে দেব, না আরও তিন হাজার ফুট এগিয়ে খাব । এমন সময় এরোপ্লেনের পুচ্ছ মাটী ছেড়ে জমির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে উঠে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে এরোপ্লেন স্থালিকা চয়ে গেল । তারপরেই গোটা এরোপ্লেনটা মাটী থেকে যেন একটা লাফ দিল, হঠাৎ চেয়ে দেখি আমি শূন্যে উড়ছি । একবার চাট মিলিয়ে নিয়ে এরোপ্লেনের মুখ হনোলুলু ও ডায়মণ্ডহেডের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম। হলোলুলু সহরের ওপর দিয়ে চলেছি, বৃষ্টিতে দুরের সমুদ্র, হনোলুলু সহরের বাড়ীঘর সব ঝাপসা। মাকালুলু দ্বীপ স্থ,মলুল থেকে অনেক দূর সমুদ্রের মধ্যে, তাও ছাড়িয়ে চলেছি। আমার বায়ে মোলোকাই দ্বীপ, বৃষ্টির ঝাপটার মধ্যে দিয়ে একটু একটু চোখে পড়ছে। আমার চারিদিকে ঘন মেঘপুঞ্জ, তাদের ওপরে যাওয়ার জন্যে আমি ৬০০০ ফুট ওপরে উঠলাম। একটা কথা এখানে বলি। এর আগে এবং পরে আমি মহাসমুদ্র বার কয়েক বিমানযোগে পার হয়েছি, কিন্তু সবশুদ্ধ এক হাজার মাইল বিস্তীর্ণ জল আমার চোখে পড়েছে কি না সন্দেহ। এর কারণ আমার আর সমুদ্রের মধ্যে সব সময়ই ছিল ঘন মেঘস্তরের ব্যবধান । প্ৰশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে সে রাত্রে যখন উড়ে চলেছি, তখন মাথার উপরকার আকাশ নক্ষত্রে শুর। মনে হচ্ছিল নক্ষত্রের দল আমার ‘ককপিটের যে জানালা, তার ঠিক বাইরে, হাত বাড়ালেই যেন ধরা যাবে। দুপুর স্নাত্রির পরে একটা নক্ষত্র দেখলাম । সেটা অন্য সব নক্ষত্র থেকে ভিন্ন। সেটা অত্যন্ত লাল, তার জ্যোতি নক্ষত্রের জ্যোতির চেয়ে অনেক বেশী । কি ওটা ? লাইট হাউসের আলো ? তারপরেই বুঝলাম সমুদ্রের বিস্তীর্ণ বক্ষ ভেদ করে কোন বড় জাহাজ যেতে খেতে বেতারে আমার ওড়ার খবর পেয়েছে এবং তার সার্চলাইট ওপরের দিকে তুলে আমায় পথ দেখতে সাহায্য করছে। আমি এরোপ্লেনের গ্যাসের সার্চলাইট তাদের দিকে ফেলে প্ৰত্যভিবাদন করলাম । আমার কাণে বেতারের হেডফোণ পরান ছিল । তার মধ্যে দিয়ে শোনা গেল, নীচের জাহাজ থেকে চারিদিকে বেতার-সংবাদ পাঠান হচ্ছে যে, আমার এরোপ্লেন দেখা গিয়েছে, অর্থাৎ আমি এখনও নিরাপদে আছি। জাহাজের সঙ্গে কথাবাৰ্ত্তা বলবার যন্ত্র আমার ছিল না, তবুও সেই মহাশূন্যে মানুষের অতি দূর সংস্পর্শেও মনটা পুসি হয়ে উঠল। পরে আমি দেখেছিলাম। সেখান ম্যাটসন কোম্পানীর জাহাজ “ম্যালিকো”। হনোলুলু থেকে ৯০০ মাইল দূরে সমুদ্র-বক্ষে আমরা পরস্পরকে দেখি । আমার চোখের সামনে একটা নক্স টাঙানো ছিল, তাতে হণোলুলু থেকে স্তানফ্রান্সিসকো পৰ্যন্ত সমুদ্র-পাণ ও ওই সমুদ্র-বক্ষে কোন জাহাজ কোথায় আছে, তাদের সঙ্গে কোথায় আমার দেখা হলে এ সব আঁকা ছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, এত বড় সমুদ্রে দুটি ক্ষুদ্র বিন্দুর সঙ্গে পরস্পর দেখাশোনার সম্ভাবনা খুবই কম, বিশেষ করে যখন একটা বিন্দু আর একটার কয়েক হাজার ফুট উপরে। ভোরের দিকে মার্কিণ যুক্তরাজ্যের নৌবহরের একখানা ছোট জাহাজ আমার এরোপ্লেন দেখতে পেয়েছে বলে সংবাদ দিয়েছিল চারিদিকে, কিন্তু এ জাহাজখানা আমার চোখে পড়ে নি । এর আগে আমি যখন আটলান্টিক পার হয়েছিলাম, তখন সূৰ্য্যাস্ত দেখা ভাগ্যে ঘটে নি, এবার কিন্তু প্ৰশান্ত মহাসাগরের বক্ষে সুৰ্য্যোদয় দেখলাম। একটু দক্ষিণ দিক ঘেসে সূৰ্য্য উঠল, আমার পক্ষে সেটা খুব ভালই বলতে হবে, কারণ সোজাসুজি সুৰ্য্যের কিরণ চোখে পড়লে মোটা কঁচের পর্যকলাওয়ালা চশমা পর্য! সত্বেও কষ্ট হ’ত ।