পাতা:বিচিন্তা - রাজশেখর বসু.pdf/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১
কবির জন্মদিনে

মধ্যযুগের অন্তে রেনেসাঁসের সময় পণ্ডিতগণ গ্রীস ও রোমের প্রাচীন সংস্কৃতি আত্মসাৎ করেছিলেন, সমগ্র ইওরোপের ঐতিহ্যকেই তাঁরা নিজের বলে গণ্য করেছিলেন। গোঁড়া খ্রীষ্টান হয়েও তাঁরা অবাধে পেগান দেবদেবীর পুরাণকথাকে সাহিত্যে স্থান দিয়েছিলেন, তাতে তাঁদের ধর্মহানি হয় নি। পিউরিটান হয়েও মিলটন গ্রীক বাগ্‌দেবীর বন্দনা করেছেন। কেবল ধর্মবিশ্বাস দ্বারা সাহিত্য শাসিত হয় না―এই ধারণা হয়তো খুব স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু ইওরোপের গুণী সমাজ বুঝেছিলেন যে জাতীয় সংস্কৃতির তথা সাহিত্যের একটি অপরিহার্য অঙ্গ প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সাহিত্যে তার উল্লেখ থাকলেই ধর্মবিশ্বাসের হানি হয় না। হয়তো অনেকে মনে করতেন যে পেগান ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গে তো খ্রীষ্টীয় ঐতিহ্যও আছে, তাতেই প্রথমটির দোষ খণ্ডন হয়েছে। আজকাল পাশ্চাত্ত্য দেশে ধর্মের গোঁড়ামি অনেকটা কমে গেছে, তার ফলে শিক্ষিত সমাজ পেগান ও খ্রীষ্টীয় ঐতিহ্য সমদৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছে।

 আমাদের দেশে মধুসূদন খ্রীষ্টান হয়েও নির্ভয়ে পৌরাণিক বৃত্তান্ত অবলম্বন করে কাব্য লিখেছিলেন। তিনি এই কাজ বিনা বাধায় করতে পেরেছিলেন, কারণ ধর্মান্তরিত হলেও তিনি পূর্বধর্মের প্রতি বিদ্বেষগ্রস্ত হন নি, তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুরা সকলেই হিন্দু ছিলেন এবং তার স্বধর্মীরা তাঁর রচনার কোনও খবরই রাখতেন না। তার পর রবীন্দ্রনাথ এসে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে ভাল হক বা মন্দ হ’ক দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য ফেলবার নয়, জাতীয় সভ্যতার ধারা বজায় রাখবার জন্য সাহিত্যে তাকে যথোচিত স্থান দিতে হবে, এবং স্থান দিলেই তার ফলে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস প্রশ্রয় পাবে এমন নয়। ‘গোরা’ গল্পের নায়কের মতে সমস্ত প্রাচীন সংস্কারই আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে এবং পানুবাবুর মতে সে সমস্তই বিষতুল্য