পাতা:বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী (শিক্ষা ও বিবিধ).djvu/৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিদ্যাসাগর-গ্রন্থাবলী—শিক্ষা

প্রদেশে সভা করিয়া, তিনি কৃষ্ণদাসকে সম্মুখে আনিতে আদেশ করিলেন। নবাব যে ইঙ্গরেজদিগকে আক্রমণ করেন, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দেওয়া তাহার এক প্রধান কারণ। তাহাতে সকলে অনুমান করিয়াছিল, তিনি কৃষ্ণদাসের গুরুতর দণ্ড করিবেন; কিন্তু তিনি, তাহা না করিয়া, তাহাকে এক মহামূল্য পরিচ্ছদ পুরস্কার দিলেন।

 বেলা ছয় সাত ঘণ্টার সময়, নবাব, সেনাপতি মাণিকচাঁদের হস্তে দুৰ্গ সমর্পণ করিয়া, শিবিরে গমন করিলেন। সমুদয়ে এক শত ছচল্লিশ জন য়ুরোপীয় বন্দী ছিল। সেনাপতি, সে রাত্রি তাহাদিগকে যেখানে রাখিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন, এমন স্থানের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। তৎকালে, দুর্গের মধ্যে, দীর্ঘে বার হাত, প্রস্থে নয় হাত, এরূপ এক গৃহ ছিল। বায়ুসঞ্চারের নিমিত্ত, ঐ গৃহের এক এক দিকে এক এক মাত্র গবাক্ষ থাকে। ইঙ্গারেজেরা কলহকারী দুর্বৃত্ত সৈনিকদিগকে ঐ গৃহে রুদ্ধ করিয়া রাখিতেন। নবাবের সেনাপতি, দারুণ গ্রীষ্ম কালে, সমস্ত য়ুরোপীয় বন্দী দিগকে ঐ ক্ষুদ্র গৃহে নিক্ষিপ্ত করিলেন।

 সে রাত্রিতে যন্ত্রণার পরিসীমা ছিল না। বন্দীরা, আতি ত্বরায়, ঘোরতর পিপাসায় কাতর হইল। তাহারা, রক্ষকদিগের নিকট বারংবার প্রার্থনা করিয়া, যে জল পাইল, তাহাতে কেবল তাহাদিগকে ক্ষিপ্তপ্রায় করিল। প্রত্যেক ব্যক্তি, সম্যক রূপে নিশ্বাস আকর্ষণ করিবার আশয়ে, গবাক্ষের নিকটে যাইবার নিমিত্ত, বিবাদ করিতে লাগিল; এবং, যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া, রক্ষীদিগের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিল, তোমরা, গুলি করিয়া, আমাদের এই দুঃসহ যন্ত্রণার অবসান কর। এক এক জন করিয়া, ক্রমে ক্রমে, অনেকে পঞ্চত্ব পাইয়া ভূতলশায়ী হইল। অবশিষ্ট ব্যক্তিরা, শবরাশির উপর দাঁড়াইয়া, নিশ্বাস আকর্ষণের অনেক স্থান পাইল, এবং তাহাতেই কয়েক জন জীবিত থাকিল।

 পরদিন প্রাতঃকালে, ঐ গৃহের দ্বার উদ্ঘাটিত হইলে, দৃষ্ট হইল, এক শত ছচল্লিশের মধ্যে, তেইশ জন মাত্র জীবিত আছে। অন্ধকূপহত্যা নামে যে অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার প্রসিদ্ধ আছে, সে এই। এই হত্যার নিমিত্তই, সিরাজ উদ্দৌলার কলিকাতা আক্রমণ শুনিতে এত ভয়ানক হইয়া রহিয়াছে; উক্ত ঘোরতর অত্যাচার প্রযুক্তই, এই বৃত্তান্ত লোকের অন্তঃকরণে অদ্যাপি দেদীপ্যমান আছে, এবং সিরাজ উদ্দৌলাও নৃশংস রাক্ষস বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। কিন্তু তিনি, পরদিন প্রাতঃকাল পর্য্যন্ত, এই ব্যাপারের বিন্দু বিসর্গ জানিতেন না। সে রাত্রিতে, সেনাপতি মাণিকচাঁদের হস্তে দুর্গের ভার অর্পিত ছিল; অতএব, তিনিই এই সমস্ত দোষের ভাগী।